Ladakh(2010)

প্যাংগং-এর পরিযায়ী


তখন আমি তখন গুয়াহাটি’তে, সালটা বোধহয় ২০০২ হবে; সময় কাটানোর জন্য একটা পূজাবার্ষিকী এক রবিবারের দুপুরে বিছানায় শুয়ে পাতা উলটাচ্ছিলাম। হঠাৎ লাদাখ ভ্রমণের উপর একটি ভ্রমণ কাহিনি চোখে পড়ল, শুরু করলাম গোগ্রাসে গিলতে। ওখানেই আমার লাদাখের ভয়ঙ্কর সুন্দর সড়ক পথের ব্যপারে ভাল লাগার শুরু। দু-হাজার দশের জানুয়ারী মাস নাগাদ ভাবলাম কোথাও ঘুরে আসি; একাই যাব, তাই বেশ দুরে কোথাও ঘুরে এলেও মন্দ হয়না? মনে পড়ে গেল লাদাখের কথা। জুলাই মাসের প্রথম শনিবারের গুমোট এক সন্ধ্যায় কালকা মেলের নির্দিষ্ট আসনে চড়ে হাওড়া থেকে রওনা দিলাম চণ্ডীগড়ের উদ্দেশ্যে।


কালকা মেল 

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই মুঘলসরাই জংশন, এরপর এলাহাবাদ হয়ে কানপুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে ঘুম দিলাম। শিকোকাবাদ জংশনে ঘুম ভাঙতে দেখি বৃষ্টি পড়ছে। এক সময় পুরানো দিল্লী স্টেশানে থামল কালকা মেল বিদ্যুৎ চমক ও প্রচণ্ড বৃষ্টি সহযোগে। এবার ট্রেনের ক্যুপ প্রায় ফাঁকা, ঘুমিয়ে পড়লাম মোবাইলে রাত দুটো তিরিশের অ্যার্লাম দিয়ে। অ্যার্লামের শব্দে ঘুম ভাঙতে দেখি আম্বালা ক্যান্টনমেন্ট জংশনের বাইরের সিগনালে দাঁড়িয়ে আমাদের ট্রেন – ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায়। হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে প্রায় চারটে নাগাদ নামলাম চণ্ডীগড় স্টেশানে। তখন প্রায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে, আমাদের ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা; যা থাকে কপালে, নেমে পড়লাম বোঝা নিয়ে। বাইরে বেড়িয়ে অটো ঠিক করতেও পারছি না বৃষ্টির জন্য, এক পেয়ালা চা খেলাম স্টেশানে। বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই একশ টাকায় একটা অটো ঠিক করে রওনা হলাম সেক্টর-৪৩’র আই.এস.বি.টি.-র উদ্দেশ্যে। ১১ কিলোমিটার রাস্তা মুষলধারে বৃষ্টিতে ও ভোরবেলায় একদম ফাঁকা, মিনিট কুড়ি বাদেই পৌঁছে গেলাম।  বৃষ্টি পড়ছিল বলে বাইরে বিশেষ দেখা গেল না, কিন্তু বোঝা গেল পরিস্কার গোছান এবং পরিকল্পিত শহর, অনেকটা আমাদের সল্টলেকের মতই, কিন্তু রাস্তা অনেক চওড়া। 


পাঞ্জাব রোডওয়েজ-এর বাসে (২ x ৩ সিট্) সকাল ছটা বেজে পাঁচ মিনিটে শুরু করে পথে পাঞ্জাবের রোপারে প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম কিন্তু হজম হয়নি বোধহয় তাই বিলাসপুর আসার কিছু আগে একটু গা-গুলিয়ে উঠল, একটু টক জল সমেত আলু-পরোটা বেরিয়ে যেতে অনেকটা ভাল লাগল। রোপার থেকেই শহরের কংক্রিটের দৈত্য গুলো উধাও হয়ে গেল, রাস্তায় ইতিউতি বৃষ্টির জল জমে। একটা ট্রিবিউন (ইংরাজী সংবাদপত্র) কিনলাম। পোস্টকার্ড-ছবির মত জায়গা একের পর এক পার হতে লাগলাম, বৃষ্টি সবুজ কে আরও কতকটা সবুজ এবং আরও অনেক দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। বেশ কিছুক্ষন ধরেই পাহাড়ের সান্নিধ্য উপভোগ করছি, এগিয়ে চলল বাস। পান্ডো-তে মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি কিন্তু আমি একটা আইসক্রীম খেলাম। এরপর যত এগোচ্ছি প্রকৃতি তত মায়াবী ও সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠছিল। মান্ডি, কুলু হয়ে বিয়াস নদীকে পাশে নিয়ে বিকাল পাঁচটায় মানালী পৌঁছে গেলাম।

একটা ব্যপার উল্লেখ না করলেই নয়, ৫ই জুলাই কেন্দ্রের সমস্ত বিরোধী দল জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি’র প্রতিবাদে ভারত বনধ ডেকে ছিল, ফোনে জানলাম কলকাতায় বনধ সফল কিন্তু চণ্ডীগড়, পাঞ্জাব বা হিমাচল প্রদেশে বনধে’র কোনও প্রভাব পরিলক্ষিত করতে পারলাম না – খুব’ই ভাল লাগল, কথায় কথায় কর্মনাশা বনধ আমার একেবারেই পছন্দ নয়! রাজনীতিকরা একথা কোনও দিন বুঝবেন কী? ঈশ্বর-ই জানেন!


মানালী পৌঁছান

মানালী-তে নামতেই হোটেলের দালালেরা ছেঁকে ধরল – কোনও বুকিং ছিলনা একটাকে ধরে একটা হোটেলে গেলাম – ভাড়া ট্যাক্স সহ সাতশ টাকা কিন্তু পছন্দ হলনা।  অফসিজনে এত টাকা ভাড়া দিয়ে তিনতলায় থাকার কোনও ইচ্ছা নেই। ছাতা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম হোটেল খুঁজতে।  দেখেশুনে ম্যালের উত্তরে – উত্তর রেলের রির্জাভেশান কাউন্টারের উল্টো দিকের রাস্তায় (ম্যালের উত্তর-পশ্চিম কোনে) – হোটেল গ্রাসল্যান্ড, ইউ.বি.আই. ব্যাঙ্ক ও এ.টি.এম.-এর উপরের দোতলায় বাথরুম সংলগ্ন ঘর, ভাড়া ট্যাক্স সহ সাড়ে চারশ টাকা। মোটামুটি, পরিস্কার, ম্যাল দেখা যায় কমন ব্যালকনি থেকে; ভালই!


হাড়ীম্বা মন্দির ও বশিষ্ঠ মন্দির 

পরেরদিন সকালে উঠে বাইরে ব্যালকনিতে বার হয়ে দেখি সেই যে দিল্লীর কিছু আগে থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে ছিল তা আজও হয়ে চলছে। স্নান সেরে বাইরে বার হয়ে এক কাপ চা খেয়ে এলাম (অত্যন্ত্য বাজে খেতে!), ভাবলাম মানালী-লেহ সড়ক পথের অবস্থা সম্বন্ধে একটু খোঁজ নেওয়া উচিত; এত বৃষ্টিতে রাস্তায় ধ্বস নেমে যাতায়াত বন্ধ হল না তো (?)। জানতে পারলাম সেরকম কোনও খবর নেই। আশ্বস্ত হয়ে হোটেলে ফিরে ক্যামেরা ও ছাতা নিয়ে বের হয়ে পড়লাম প্রাতঃরাশ সারবার জন্য, শেষ করে ভাবলাম একটু বিপাশা নদী-কে দেখে এলে কেমন হয় ব্রীজের ধারে যেতে না যেতেই একটা সুমো ট্রাভেলার গাড়ি আমার প্যান্ট ভিজিয়ে চলে গেল। অগত্যা দু-একটা ছবি তুলে হোটেলে ফিরে প্যান্ট বদলিয়ে পদব্রজে ছাতা মাথায় মহাভারতের চরিত্র ভীমের স্ত্রী হিড়িম্বা দেবী মন্দির দেখতে চললাম হাঁটার কারন লাদাখের উচ্চতার সাথে গা সইয়ে নেবার আগে শরীরটাকে একটু তৈরি রাখা, যদিও মানালী মাত্র ৬,৪০০ ফুট উঁচু।

বাপ-রে-বাপ, পাহাড় চড়ার কোনও অভিজ্ঞতা নেই সবটুকু দম এক করে কোনও রকমে পৌঁছে গেলাম। আসলে আমার ছয় ফুট উঁচু, কমবেশি নব্বই কেজির শরীর কে টানতে একটু মেহনত না করলে চলবে কেন? উপলব্ধি করলাম গাড়িতে চড়ে এলে বৃষ্টিস্নিগ্ধ মানালী-কে পথের প্রতিটি বাঁকে নতুন করে চিনতেই পারতাম না। খচাখচ কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। দেবদারু কাঠ, মাটি ও পাথর দিয়ে পুরো মন্দির ১৫৫৩ সালে তৈরি। লাইন দিয়ে হিড়িম্বা মন্দির দর্শন করলাম ও পূজা দিলাম যাত্রা পথে কোনও বিপদের সম্মুখিন না হই, সুস্থ শরীরে ঘরে ফিরতে পারি ইত্যাদি ইত্যাদি প্রার্থনা করে হিড়িম্বা মাতার আর্শীবাদ নিলাম এরপর হিড়িম্বা মার পুত্রের ঘটোৎকচ মন্দির দেখে হেঁটে ফিরে এলাম। ফেরার পথে ঢালু রাস্তার জন্য কোনও কষ্ট হয়নি।

এরপর দেড়শ টাকা দিয়ে একটা অটো ভাড়া করে চললাম বিয়াস নদীর অন্য প্রান্তে অবস্থিত বশিষ্ঠ মন্দির দেখতে। ওখানে উষ্ণ প্রস্রবন (গরম জলের কুণ্ড) আছে, স্নান করলে নাকি চর্মরোগের উপশম হয়। বশিষ্ঠ মন্দির ও লাগোয়া রাম মন্দির দেখে, ছবি তুলে ফিরে এলাম মানালী, তখন দুপুর দুটো বেজে গিয়েছে। খিদেও পেয়েছে বেশ সমতলের মানুষ হিসাবে পরিশ্রম তো আর কম হয়নি? একটা হোটেলে নিরামিষ ভাত খেয়ে খবরের কাগজ কিনে হোটেলে ফিরে এলাম।  এদিকে বৃষ্টি পড়ায় ছেদ পড়ে নি, বিশেষ জোরে না পড়লেও একনাগাড়ে পড়েই চলেছে। কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না ঘুম ভাঙতে দেখি সাড়ে চারটে বাজে এবং বৃষ্টি টিপটিপ করে পড়ে চলেছে। বাইরে বেরিয়ে দেখি পাশের দুটি ঘরে বাঙালী ভ্রমনার্থী পরিবার এসেছে জম্মু শ্রীনগর-লেহ ঘুরে। বিশেষ কথা বাড়ালাম না ওনারা ক্লান্ত, নিশ্চয়ই স্নান সেরে, খেয়ে দেয়ে ঘুমাবেন, সন্ধ্যা/রাত্রে কথা বলা যাবে।


তিব্বতী গোম্ফা  

এরপর ক্যামেরা ও ছাতা নিয়ে বের হয়ে পড়লাম কাছাকাছি তিব্বতি গোম্ফা দেখার জন্য। ম্যালের নিচে একটু হাঁটলেই নেচার পার্কের বা দিকে রাস্তায় গোম্ফা। সামনে প্রচুর রং বাহারী ফুলের বাগান। দুপাশে ফুলের বাগিচা পার হয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। দর্শনি নেই; ক্যামেরা সহ ছবি তোলার অনুমতি নিতে আলাদা খরচ আছে দশ টাকা মাত্র। ভিতরে ভয়ঙ্কর দর্শন দুখানা রাক্ষসের মত মূর্তির মাঝখানে মহাজ্ঞানী বুদ্ধদেবের শান্ত, স্নিগ্ধ ও প্রসন্ন মূর্তি। ছোট্ট জায়গা কিন্তু বেশ সুন্দর লাগে; বাইরে ড্রেস ভাড়া নিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে কিন্তু আমার আর ভাল লাগছিল না কারন এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে তুলতে হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছে।

ঘুম থেকে উঠে চা খেতে টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় ছাতা হাতে একটা গলির দোকানে ঢুকেছি দেখি পুরো বাঙালী পরিবারটি হাজির। কথায় কথায় জানতে পারলাম ওনারা বেহালার বাসিন্দা স্বামী, স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রের মামা। ভদ্রলোক ইউকো ব্যাঙ্কে ও অকৃতদার মামা লিলুয়ায় রেলের ওয়ার্কশপে কর্মরত। ছেলেটি কলেজে পড়ে ও তার সোনি ডিজিটাল ক্যামেরাতে প্যাংগং লেকের ছবি দেখাল। ওরা লেহ শহর, খারদুংলা পাস ও প্যাংগং লেক দেখে লোকাল বাসে কেলং হয়ে দু দিনে মানালী পৌঁছেছে। পথে বারালচালা পাসে তুষার পাত দেখেছে রাস্তা খুবই খারাপ অবস্থায়। আমিও জানালাম আমিও চারদিনে ওই জায়গাগুলোই দেখব এবং আজই (বুধবার) রওনা।


যাত্রা স্থগিত

এরপর আমি হোটেলের ভাড়া মিটিয়ে, এইচ.পি.টি.ডি.সি., মানালীর মার্কেটিং অফিসে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ঠিক কটার সময় রির্পোট করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীটি জানাল কাল বিকাল থেকে রোটাং পাসের আগে রোহিণী-নালা’য়, রোটাং পাসের পরে কেলং-এর রাস্তায় খোকসার’এ এবং বারলাচা পাসে ধ্বস নেমে রাস্তা বন্ধ। আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ল। কর্মচারীটি আরও জানাল যে যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন রাস্তা পরিস্কারের চেষ্টা করছে তবুও একবার দশটা নাগাদ ঢুঁ মেরে যেতে অবস্থার গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে বিশদে জানতে।

ভগবানকে এক প্রস্থ মনে মনে বকাবকি করে প্ল্যান করলাম যদি নাই যেতে পারি তবে মানালী সংলগ্ন সব দ্রষ্টব্যস্থল ভাল করে দেখে তবেই ফিরব। প্রাতঃরাশ সেরে এইচ.পি.টি.ডি.সি., মানালীর মার্কেটিং অফিসে গিয়ে আবার পরিস্থিতি জিজ্ঞাসা করলাম। ওনারা বললেন আমি টিকিট বাতিল করে পুরো ভাড়ার টাকা ফেরৎ নিতে পারি অথবা পরের দিন রাস্তা খুললে বাসে রওনা দিতে পারি। আমি বললাম কাল বাস না চললে টিকিট বাতিল করে টাকা ফেরৎ নেব এবং ওনাদের অফিসের প্যাডে লিখে দিতে হবে এই এই কারনে রাস্তা বন্ধ হবার জন্য বাস চলাচল রদ করা হয়েছে। ওনারা সম্মতি জানালেন।


নাগর প্যালেস, রোয়েরিখ আর্ট গ্যালারী, লক্ষ্মী-নারায়ন মন্দির ও প্রাচীন গায়ত্রী দেবী মন্দির

একরাশ দুঃখ নিয়ে হিমাচল ট্যাক্সি ওনার্স অ্যাসোসিয়েনের অফিসে দেখা করে রাস্তার হাল হকিকত জানলাম ওরা বলল আশা রাখা যায় যে কালকে সকালের আগে রাস্তা অবশ্যই খুলে যাবে। দিন যাতে নষ্ট না হয় তাই ওদের ওখান থেকে ছয়শ টাকায় গাড়ি ভাড়া করলাম নাগর প্যালেস, রোয়েরিখ আর্ট গ্যালারী, বিষ্ণু মন্দির ও গায়ত্রী দেবী মন্দির দেখবার জন্য। এরপর হোটেলে ফিরে থাকা একদিন বাড়িয়ে নিলাম এবং এগারোটা নাগাদ রওনা দিলাম।

প্রথমে রুশ শিল্পী তথা লেখক তথা পাহাড় প্রেমী নিকোলাস রোয়েরিখের আর্ট গ্যালারী দেখতে গেলাম। ত্রিশ টাকার টিকিট, ফটোগ্রাফির জন্য গ্যালারীর ভিতর ক্যামেরা ব্যবহার করলে আরও ত্রিশ টাকা (আমি দ্বিতীয়টির সুযোগ নেইনি)। সুদৃশ্য লন, পাশে সুন্দর পাহাড়ী ফুলের গাছ রেলিং হিসাবে দেওয়া আছে। দোতলা - কাঠ ও পাথরের পুরানো একটি বাড়ি যদিও যথেষ্টই পরিচর্যা করা হয় বাড়ি ও সংলগ্ন বাগানের। একটি পুরানো দিনের গাড়িও  আছে (বেবি অষ্টিন হবে বোধ হয়) গ্যারাজে। ঘাসে ও ভিজে মাটিতে জোঁকেরা ঘোরা ফেরা করছে এরকম স্যাতস্যাতে আবহাওয়া ওদের বাড়বাড়ন্তর জন্য আদর্শ। ভিতরে ওনার আঁকা বেশ কিছু তৈল চিত্র প্রশংসার দাবী রাখে যদিও জীবন বিজ্ঞানের কিছু ছবি আঁকা ছাড়া আমার চিত্রকলার বিষয়ে সমালোচনা করার অধিকার বা ক্ষমতা কিছুই নেই তবুও, চোখ এবং মনকে ছুয়ে যায় বৈকি। একটা স্মারক কিনে, পুরো বাড়িটা ঘুরপাক খেয়ে চলে এলাম গাড়ির কাছে।

পরের গন্তব্য নগর প্যালেস। প্রবেশ মূল্য পনের টাকা মাত্র। এক কালে এটি কুলু রাজের রাজপ্রাসাদ ছিল, এখান থেকেই সমস্ত রাজ্য পরিচালনা করা হত এখন এইচ.পি.টি.ডি.সির  একটি রেস্তোরায় রুপান্তরিত হয়েছে। পুরো প্রাসাদের পরিক্রমা সেরে নিলাম বৃষ্টি বাঁচিয়ে, ছাতা মাথায়। প্রাসাদ থেকে কুলুর অসাধারন প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করা যায় যেটা বৃষ্টি পড়ে আরও মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে। প্রচুর ছবি তুললাম, তারপর গাড়িতে উঠে পড়লাম।  ড্রাইভার সাহেব জানালেন যদি আমি আর পাঁচ মিনিট দেরি করতাম রোয়েরিখ আর্ট গ্যালারীতে তবে ধ্বসে আটকে পড়তে হত; ভগবানকে ধন্যবাদ জানালাম।

এরপর বিষ্ণু মন্দির ও প্রাচীন গায়ত্রী দেবী মন্দির দেখে ফিরে এলাম মানালী, তখন ঘড়ির কাঁটা তিনটে ছুয়ে ফেলেছে। পথচলতি এক হোটেলে বেঁচে থাকা ভাত মাছ দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবৃত্ত করলাম। জানতে পারলাম আজ বিয়াস নদীর জল একাধিক যায়গায় জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে বইছে, এছাড়া মানালী-কুলু সড়ক পথ একাধিক জায়গায় ধ্বস নেমে বন্ধ, এমনকি দিল্লী চণ্ডীগড় রেল যাতায়াত কাল বিকাল থেকে বন্ধ। পুরো পাঞ্জাব রাজ্য বন্যা কবলিত এবং আমরা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাবলে সমস্যার সমাধান হবে না তাই হোটেলে এসে টেনে ঘুম লাগালাম।

বিকালে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে দেখি বৃষ্টি ধরে গিয়েছে, বাইরে বার হলাম, অনেক দিন বাদে সূর্য দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলাম। পুরো ম্যাল তখন গমগম করছে, এই কদিন কয়েকটা মাত্র লোক ছাতা মাথায় টিমটিম করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এত নৈসর্গ প্রেমী এখানে ভিড় করে আছে বুঝতে পারিনি। রাত্রে ধাবাতেই খেতেখেতে জানতে পারলাম রাস্তা খুলে গিয়েছে। কিছু টুরিষ্ট খোকসার ও রোটাং পাসে একদিন আটকে থাকার পর কিছু আগে ফিরে এসেছে। কাল বাস চলবে এই আশা আরও প্রগাঢ় হল। জিনিস পত্র গোছানই ছিল, ভগবানকে প্রনাম করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।


বৃহস্পতিবার সকালে অন্য দিনের মতই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়লাম।  বাইরে বার হয়ে দেখি আকাশ পরিস্কার সূর্য উঠেছে। স্নান সেরে রেডি হয়ে হোটেলের ভাড়া মেটালাম। বাইরে বেরিয়ে পড়লাম প্রাতঃরাশ ও মধ্যাহ্নভোজনের মাঝামাঝি একটা কিছু সারতে। আপাদমস্তক বাঙালী দিনে অন্তত একবার ভাত না পেলে মনে হয় কিছু একটা বাকি থেকে গিয়েছে। ধাবাওয়ালা জানাল এগারোটার আগে দিতে পারবে না। কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে ইতি উতি তাকাচ্ছি দেখি রাস্তার উল্টো দিকে দোতলায় একটা রেস্তোরা, যাতে বাংলায় লেখা নিউ আশাপুরি ভোজনালয়। রাস্তার পাশের গলিতে সিড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে হিন্দীতে ভাত পাব কী না জিজ্ঞাসা করতেই পরিস্কার বাংলায় উত্তর মিলল - পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নিরামিষ বা আমিষ; রুই, পাবদা, ট্যাংরা, ট্রাউট মাছের পদ পেয়ে যাবেন। আমি নিলাম আলু-পোস্ত ও রুই মাছের ঝোল সহযোগে আলু ঝুরি, করলা ভাজা, ডাল, চাটনি, সহযোগে ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালি।  তোফা খাওয়া হল বড় তৃপ্তি করে খেলাম। টাকা মিটিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করাতে বলল ওনারা হাওড়ার বাসিন্দা, এই হোটেল লীজ নিয়েছেন বছর পনেরো ধরে।


লেহ্-র উদ্দেশ্যে রওনা  

নমস্কার জানিয়ে বাইরে বেড়িয়ে শখ করে একটা ফোল্ডিং ছুরি কিনলাম। বেলা দশটায় এইচ.পি.টি.ডি.সি., মানালীর মার্কেটিং অফিসে রির্পোটিং করতে হবে, কয়েক মিনিট আগেই ঢুকে পড়লাম। ওনারা জানাল রাস্তা খুলে গিয়েছে, বাসের নম্বর জানতে সাড়ে দশটায় চলে আসতে। বাস ছাড়বে বেলা এগারোটায়। আমি সোজা ওষুধের দোকানে গিয়ে এক পাতা অ্যাভোমিন কিনে নিলাম এবং বাইরে থেকে একটা পাঞ্জাব কেশরী ইংরাজী দৈনিক সংবাদপত্র কিনে হোটেলে ফিরে এসে দশটা কুড়ি মিনিটে মাল পত্র সমেত ঢুকে পড়লাম এইচ.পি.টি.ডি.সি., মানালীর মার্কেটিং অফিসে। বাস নাম্বার পেতেই সোজা বাসস্ট্যান্ডে হাজির হয়ে বাসে মাল পত্র উপরে তুলে দিলাম। আমার নির্ধারিত জায়গা ছিল সাত নাম্বার সিট, বাঁ দিকের সারিতে প্রথমটি ছেড়ে পরের জানালার ধারেরটি। একটা অ্যাভোমিন খেয়ে নিলাম। টিকিট পরীক্ষা হয়ে গেল এগারোটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগেই এবং ড্রাইভার সাহেব ইঞ্জিন চালু করে কনডাকটরকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল ফিরল এগারোটা পয়ত্রিশে। বলা বাহুল্য আমি কলকাতার চাঁদনী চক স্থিত হিমাচল ট্যুরিজমের অফিস থেকে দুই হাজার টাকা মুল্যের টিকিট (কেলং-এ তাঁবুতে থাকা ও রাত্রে এবং সকালের খাওয়ার খরচ ধরে) অগ্রিম কেটেই মানালী হাজির হয়েছিলাম।

শেষ পর্যন্ত পৌঁনে এগারোটা নাগাদ মোট চব্বিশ জন যাত্রী (বাস ড্রাইভার, কনডাকটর ও এইচ.পি.টি.ডি.সি., লেহর ম্যানেজার সমেত) সমেত বাস যাত্রা শুরু করল লেহর উদ্দেশ্যে। প্রথমেই পার হলাম বিয়াস নদীকে, এবার সুন্দরী বিয়াস তার স্ফটিক স্বচ্ছ জলের স্রোত নিয়ে, আমাদের বাঁ দিকে আমার দুই যমজ শিশুকন্যাদ্বয়ের মত দুষ্টুমি করতে করতে ছুটে চলেছে। আমার মেয়েদের মুখ মনে পড়ে গেল আর কিছুক্ষনের জন্য আমি ফ্ল্যাশব্যাকে বাড়িতে ঘুরে এলাম। একে একে কোঠি, পলচানের মত ছোট ছোট ছবির মত সুন্দর জনপদ পেরিয়ে মারহীর দিকে এগোতে থাকলাম, উচ্চতা ১১,২০০ ফুট। পথে প্যারাগ্লাইডিং দেখলাম, কোনও একটা ছবির শুটিংও হচ্ছে মনে হল। চারজনের একটি পরিবার বাসে উঠল, ওরা লেহ যাবে।

মারহীর আসার একটু আগে একটা ছোট বাঁধ দিয়ে বেশ একটা ছোট লেক মত দেখলাম, যে নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে তাতে অনেকে চড়ুইভাতি করছে। আমাদের বাস প্রথম বার জ্যামে আটকাল, পরের বাঁকেই মারহী গ্রাম। মোটামুটি পয়তাল্লিশ মিনিট পর ছাড়ল। মুলতঃ, ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ী চালানোর জন্যই এই জ্যাম আমরা ভারতীয়রা বিশেষ শৃঙ্খলাপরায়ণ নই। মারহীতে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আধ ঘন্টা থামবে। আমাদের ভাত খাওয়া আছে, তাই কফি ও ম্যাগী নিলাম, খরচ যথাক্রমে পনের টাকা ও ত্রিশ টাকা মাত্র। কোনও রকমে শেষ করে বাসে উঠে পড়লাম। সাড়ে তিনটে নাগাদ বাস আবার গোঁ গোঁ করে শুরু করল কিন্তু একটু যায় আবার আটকে যায়। প্রথমতঃ বেপরোয়া গাড়ী চালানো, দ্বিতীয়তঃ ছোটোখাটো ধ্বস মেরামত সবে মিলে পাঁচ মিনিট এগোয় তো আধ ঘন্টা দাঁড়ায়। বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা ভরা বর্ষায় ফুটবল খেলার পর যা হয় কতকটা সেই রকমই, থিকথিকে কাদা।


রোটাং পাস

রোটাং একটি তিব্বতী কথা, যার মানে মৃতদেহর স্তুপ। প্রাচীন কাল থেকে শক, হুন ও অন্য দস্যুদের আক্রমন ঠেকিয়েছে এই গিরিপথ। কত বৌদ্ধ শ্রমণ এই পথে পার হতে গিয়ে এখানেই প্রান ত্যাগ করেছেন। বুৎপত্তিগত অর্থ ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায় তবে রাস্তা বাদ দিয়ে বাইরে তাকালেই মন ভরে যাবে। কি সুন্দর অপরুপ দৃশ্য। নিচে মারহী আর উপরে রোটাং জট। জিগজ্যাগ রাস্তায় প্রচুর চুলের কাঁটার মত বাঁক পেরিয়ে একসময় পেরিয়ে এলাম বিখ্যাত রোটাং পাস, উচ্চতা ১৩,০৫১ ফুট। ইচ্ছা ছিল কিছু ছবি তুলব কিন্তু তখন রাত্রি আটটা পাঁচ বাজে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না, সবার সম্মতি নিয়ে বাস না থেমে এগিয়ে চলল। মাঝে একবার থামল গ্রামফুর কিছু আগে বাথরুম সারবার জন্য, এখানে রাস্তা দুই দিকে চলে গিয়েছে। বাঁ দিকে গিয়েছে তান্ডি হয়ে লাহুল উপত্যকার সদর শহর কেলং হয়ে লেহর দিকে আর ডান দিকে কুঞ্জুম পাস হয়ে স্পিতি উপত্যকার সদর শহর কাজাতে। আমরা বাঁ দিকে এগিয়ে চললাম খোকসারে আবার থামল। এখানে বিদেশী ভ্রমণার্থীদের তথ্য এবং পাসপোর্ট ও ভিসা পরীক্ষা করা হয়।  মিনিট কুড়ি বাদে আবার রওনা হয়ে তান্ডি পৌঁছে গেলাম। এখানে রাস্তা আবার দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে, একটা উদয়পুর, ত্রিলোকিনাথ হয়ে কিল্লরের দিকে গিয়েছে অন্যটা আমাদের রুট কেলং হয়ে লেহ। এখানে জ্বালানী তেল নিতে হবে, পরের পেট্রোল পাম্প লেহতে মাত্র ৩৬৫ কিমি দুরে। ভাগ্য খারাপ, পাম্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাই আমরা এগিয়ে চললাম কেলংএর দিকে, উচ্চতা ১০,১০৪ ফুট। সরকারী বাস ডিপোতে ঢুকে তেল নিয়ে আমাদের বাস যখন হোটেল চন্দ্রভাগায় পৌঁছে দিল তখন সময় রাত বারোটা পনেরো, মানে শুক্রবার হয়ে গিয়েছে।


হোটেল চন্দ্রভাগার তাঁবু

মাল-পত্র নামিয়ে দিয়ে আমাকে একটা তাঁবু দেওয়া হল। বালিশ, কম্বল সহ মোটামুটি অপরিছন্ন তিন খানা বিছানা, একটা বাল্ব জ্বলছে। আমাদের বলা হল ডাইনিং রুমে যেতে। আপনাদের বলা হয়নি, এইচ.পি.টি.ডি.সি’র ডিলাক্স লাক্সারী বাসে মানালী-লেহর ভাড়া মাত্র দুই হাজার টাকা, এরমধ্যে কেলং-এ হোটেল চন্দ্রভাগায় তাঁবুতে থাকা, রাত্রের নিরামিষ খাবার ও সকালের প্যাকেট ব্রেকফাস্টের খরচ ধরা আছে। শুধু যাবার ভাড়া মাত্র পনেরশ টাকা। বলা বাহুল্য আমি কলকাতার চাঁদনী চক স্থিত হিমাচল ট্যুরিজমের অফিস অগ্রিম টিকিট কেটেই মানালী হাজির হয়েছিলাম।

মাল-পত্র বুঝে নিয়ে, তাঁবুতে রেখে, হাত-মুখ ধুয়ে, তিনতারা হোটেল চন্দ্রভাগায় ডাইনিং রুমে বসলাম। বেশ খানিকটা জল খেলাম, মোবাইল চার্জ দিয়ে নিলাম। প্রথমে স্যুপ দিল ও রাত বেশি হয়ে গিয়েছে বলে খাবার দিয়ে দিল। বুফে সিস্টেমে নিরামিষ খাবারের ঢালাও আয়োজন। ভাল করেই রুটি-ভাত, ডাল ও দুই পদের নিরামিষ তরকারি আঁচার সহকারে ভাল করেই খেলাম। এরপর সোজা তাঁবুতে ফিরে মোবাইলে ভোর তিনটের অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। তাঁবুর পর্দা বন্ধ করা গেলেও নিচে ফাঁকা অনেকটা, মোটেও গরম বা আরামদায়ক নয়। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে আমার খুবই শীত করছিল। কথা হল আমাকে তিনটেয় বেড-টি দিয়ে ডেকে দেবে।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, ঘড়ি দেখলাম দেখি তিনটে কুড়ি বাজে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁত মেজে, হাত মুখ ধুয়ে, চা খেয়ে নিয়ে বাথরুমে গেলাম; দেখি আলো জ্বলছে না এবং মগ নেই, ভাগ্যিস বালতিটা ছোট ছিল। প্যাকেট ব্রেকফাস্ট নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এলাম, বাস ছাড়বার সময় ভোর সাড়ে চারটে। আবার মাল-পত্র নিয়ে বাসের কাছে এলাম, ড্রাইভার স্পাইডারম্যানের মত ক্ষিপ্রতার সাথে আমাদের ল্যাগেজ বাসের মাথায় তুলে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দিল।


কেলং থেকে লেহ্-র উদ্দেশ্যে রওনা 

ভোর ঠিক চারটে চল্লিশে বাস ছেড়ে দিল, আজ শুক্রবার। আমি ব্রেকফাস্টের প্যাকেট থেকে একটা আলুর বড়া (ওয়াক! এত বাজে খাবার আমি জীবনেও খাইনি) খেয়ে নিয়ে একটা অ্যাভোমিন জল দিয়ে গলাধঃকরন করলাম। কোনও যাত্রীরই ঘুম হয়নি, বাস চলতেই ঘুমে সক্কলের চোখ আচ্ছন্ন হয়ে এল, আমার অবস্থাও বিশেষ ভাল নয় কিন্তু সকালের আবছা আলোয় কেলং-এর প্রাকৃতিক সৌন্দয্যে মোহিত হয়ে ঘুম ত্যাগ করলাম। একেএকে জেমুর (স্টেট ব্যাঙ্কের শাখা আছে), জিস্পা হয়ে এগিয়ে চললাম, আমাদের সঙ্গী ভাগা নদী। এখানে প্রকৃতি কিছুটা রুক্ষ হয়ে গেলেও সবুজ যথেষ্টই বর্তমান, বস্তুতইঃ জিস্পা (উচ্চতা ১০,৫০০ ফুট), কেলং-এর থেকে আরও কিছুটা বেশিই সুন্দরী, যদিও তুলনা করতে চেষ্টা করা বোকামো।


বারালাচা পাস ও সুরজতাল 

আমার প্রী-পেড মোবাইলের সিগনাল (বি.এস.এন.এল. ও এয়ারটেল) এরপর হারিয়ে গেল। এখান থেকেই প্রকৃতি তার রুক্ষ রুপে আমাদের দেখা দিচ্ছিল। ভাগা নদীর উপরে দুটি ব্রীজ পার হয়ে এরপর দারচা পৌঁছে গেলাম, উচ্চতা ১১,০২৩ ফুট। এখান থেকে রাস্তা বেশ ভাল হতে শুরু করল, একপ্রস্থ চেকিং সেরে এগিয়ে চলল বাস। আমি প্যাকেট ব্রেকফাস্টের মাখন ও জ্যাম দিয়ে মোট চার টুকরো পাউরুটি খেয়ে প্যাকেট ওখানেরই একটি কুড়াদানে (ডাস্টবিনে) ফেলে দিলাম। কিছুদুর গিয়ে একটি বাঁকের মোড়ে বাস থামল বাথরুম ব্রেক নিতে। তারপর পাটসিও সেনাছাউনি পার হয়ে, জিংজিংবার পেরিয়ে দীপক তাল (একটু ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম, ভাঙবার পর আর ছবি তোলবার সুযোগ পাইনি) হয়ে সুরজতাল চলে এলাম। প্রায় পুরোটাই বরফে ঢাকা, দুধ সাদা। এখান থেকেই ভাগা নদীর উৎপত্তি। অদুরেই বিখ্যাত বারলাচা পাস (উচ্চতা ১৬,০৪০ ফুট), এটি হিমালয় পর্ব্বতশ্রেনীর একটি শৃঙ্গ। এখানেই মৌসুমী বায়ু বাধাপ্রাপ্ত হয়ে লাদাখের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারেনা। বাস এক সময় বারলাচা পাসে থামল একটু চওড়া জায়গা দেখে। কারন আমাদের বাস ভলভো বাসের সামান্য ছোট সংস্করন, রাস্তা রেখে না দাঁড়ালে যানজটের কারন হতে পারে।

একটা ছোট মন্দির আছে পথের ডান দিকে কিন্তু প্রবেশ পথ বরফে ঢাকা। একটা ছোট স্তুপ বা চোর্তেন আছে সাথে আছে তিব্বতী ভাষায় মন্ত্র লেখা প্রার্থনার সারি সারি লম্বা দড়ির গায়ে গালানো পতাকা। প্রায় সব গিরিবর্ত্বেই এই প্রকার চোর্তেন সহ প্রার্থনার পতাকার দেখা যায়। সকাল আটটা পাঁচ মিনিটে থামল বারলাচা পাসে। পাশে একটা ছোট্ট হিমবাহ, আকাশে সূর্যের আলোর ছ্বটায় বরফের গা বেয়ে মনে হচ্ছে ধবধবে সাদা দুধের বন্যা হচ্ছে। সবাই ছবি তুলে, বাথরুম সেরে বাসে উঠতে ফের রওনা দেওয়া গেল মিনিট দশেকের মধ্যে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই কিলিংসরাই পেরিয়ে ভরতপুর চলে এলাম। ভাবতেও ভাল লাগছে যে আমরা হিমালয় পর্বত শ্রেনী পার হয়ে এগিয়ে চলেছি। এতক্ষন রাস্তা ভাল ছিল কিন্তু কিলিংসরাইয়ের কিছু আগে থেকেই রাস্তা আবার খুব খারাপ হয়ে গেল।  এখানে আমাদের ব্রেকফাস্ট ব্রেক।  আমরা একটা তাঁবুতে ঢুকে চা ও ম্যাগি অর্ডার দিলাম এবং তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বাসের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।  চা দশ টাকা ও ম্যাগির খরচ ত্রিশ টাকা মাত্র। প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এবার আমরা সারচুর দিকে এগোতে থাকলাম। আমরা মোটামুটি ১৪,০০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে এখন চলছি কিন্তু বিশেষ কষ্ট অণুভূত হচ্ছে না, শরীর উচ্চতার সাথে বেশ খাপ খাইয়ে ফেলেছে। বাঁ দিকে সারাপ-ছু নদী কে সঙ্গী করে ছুটে চলেছি, মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি আমাদের কে অতিক্রম করে আরও জোরে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে দৌড়ে যাচ্ছে।  নদী খাতের অপর পারে প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে, তীব্র হাওয়া কে হাতিয়ার করে অপরূপ শিল্প গড়ে তুলেছে।  হাওয়ার ঘর্ষনে পাহাড়ের গায় সারিসারি রকেটের মত মূর্তি তৈরি হয়েছে; সারচু রকেটস! দুরে একপাল ভেড়া চড়ছে, রাখালের দেখা নেই।


সারচু রকেটস 

বেলা দশটায় সারচু এসে পৌঁছালাম। উচ্চতা ১৪,০৭৪ ফুট। সারচু হল হিমাচল প্রদেশ ও জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্ত। আরও একবার যাত্রীদের তথ্য সেনার কাছে দেওয়া হল। বিদেশী যাত্রীদের পাসপোর্ট ও ভিসা বিশদে হিমাচল সীমান্তেই পরীক্ষা করে আমাদের ছেড়ে দিল আধ ঘন্টার ভিতর। এখানে কিছু তাঁবু আছে, টুকিটাকি খাবার থেকে, রাত্রে শোবার সবই বন্দোবস্ত আছে। গণ্ডগোলটা অন্য জায়গায় রাত্রীবাসের ব্যবস্থা হয় উচ্চমানের (রাতের ও সকালের খাওয়া নিয়ে, মানুষ প্রতি দু-হাজার টাকা) অথবা নিম্নমানের (রাত্রে শোয়া একশ টাকায়); কোনও মাঝারী বন্দোবস্ত নেই। এখানে পুরো সময়টাই বাইরে ঘোরাফেরা করছি কিন্তু একটু কেমন যেন পা-ভারী অনুভূত হচ্ছিল। বেশি উচ্চতায় মাধ্যাকর্ষণ একটু বেশি মাত্রায় হবে বোধহয়।

এরপর সেনা ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি একটা অস্থায়ী ব্রীজ পার করে জম্মু-কাশ্মীরে প্রবেশ করলাম। ভরতপুর থেকে রুক্ষ মরুপ্রান্তরের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছি, জম্মু-কাশ্মীরেও তার কোনও পরিবর্তন হল না। একটু এগোতেই একটা উপত্যকার বুক চিরে রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে আরও উত্তরে, বাঁয়ে উত্তুঙ্গু পাহাড় আর ডাইনে পাহাড়ের ঢালে সারিসারি তাঁবু। সবকটাই বোধহয় উচ্চমানের। এগিয়ে চললাম ওদের কে পিছনে ফেলে রেখে। চলাই তো জীবন, অতএবঃ... চরৈবেতি!

অনেকক্ষনই রুক্ষ মরুপ্রান্তরের মধ্যে দিয়ে চলেছি কিন্তু অদ্ভুত ভাবে প্রতি দশ-পনের মিনিট অন্তর রুক্ষতার পরিভাষা বদলে বদলে যাচ্ছে। পাহাড়ের রং বদলে যাচ্ছে, কখনও কালচে কখনওবা লালচে বা কোথাও বাদামী-মেটে রঙের। চোখ বন্ধ করে দু-দন্ড জিরিয়ে নেব, প্রকৃতি কোনও সুযোগ দিচ্ছেনা। রুক্ষতা কত সুন্দর হতে পারে বোধকরি লাদাখে এসে চক্ষুঃষ্মান না করলে, ভ্রমণ পিপাসু বাঙালীর যাত্রা অসম্পূর্ন থেকে যাবে। পাশে নদী তিরিতিরি করে বয়ে চলেছে, কাছাকাছি কোনও জনপদ নেই, কিন্তু হঠাৎ করে ভেড়ার পাল নিয়ে দু-একটি মানুষ হেঁটে চলেছে, ভেড়াদের খাবার না হয় পাহাড়ের ঢালে জন্মানো ঘাস বা গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ, কিন্তু ওই মানুষ গুলি কী খেয়ে জীবনযাপন করে, ওদের ভেড়ার লোম-ই বা কারা কিনে শীতপোশাক বানায় ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে চোখ বুঝি বা একটু বুঝে এসেছিল। এমন সময় চমকে দিয়ে এখন আমরা গাটা লুপ-এর চড়াই পার হব, হিন্দীতে ও ভাঙা ইংরাজীতে কনডাকটর বলে উঠলেন।


গাটা লুপ, নাকী লা ও লাচুলুং লা পাস

গাটা লুপ হল মোট একুশ(২১) খানা মেয়েদের চুল বাঁধার কাঁটার মত বাঁক বিশিষ্ট চড়াই, ইংরাজী পরিভাষায় হেয়ার পিন বেন্ড। মোট সাত কিলোমিটার পথে রাস্তা প্রায় দুহাজার ফুট উচুতে উঠে গিয়েছে। রাস্তাটা যারা আবিস্কার করেছিলেন  সেই মহাত্মাদের মনে মনে প্রণাম জানিয়ে বাসের পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে চড়াই ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চললাম। মধ্যে মধ্যে রাস্তা সংক্ষেপ করবার জন্য আড়াআড়ি মাটির রাস্তা আছে, তবে সেটা ছোট গাড়ি বা বাইক আরোহী দের জন্যই ঠিক আছে, আমাদের মত বিশাল বাস বা ট্রাকের জন্য নয়। মিনিট কুড়ির মধ্যেই আমরা পুরোটা চড়াই ভেঙে পাহাড়ের উপরে উঠে পড়লাম।

গাটা লুপ পার হবার অব্যবহিত পরেই পেলাম নাকিলা পাস, উচ্চতা ১৫,৫৪৭ ফুট। এখানে উঠে এসে ড্রাইভার বাস থামাল, আমি দু-একটা ছবি তুললাম। এই পাহাড়ে দেখি কারা যেন ছোট ছোট পাথর দিয়ে একের উপর এক-একটি পাথর সাজিয়ে প্রচুর ছোট ছোট প্রার্থনার স্তুপ বা র্চোতেন তৈরি করেছে। এই গিরিপথেও চোর্তেন সহ প্রার্থনার পতাকার ব্যাতিক্রম নেই। এই পান্ডববর্জিত জায়গায় ভগবানের বুদ্ধের ভক্তগন তাঁকে স্মরন করছে দেখে বেশ অবাকই হলাম। আমি প্রচুর চকোলেট নিয়ে এসেছিলাম, তারই একটা চুষতে চুষতে বাসের মধ্যে সামান্য টলোমলো পায়ে উঠে পড়লাম। বেশি উচ্চতায় এই রকম একটুআধটু শারীরিক উপসর্গ দেখা যায় বৈকি।

আবার বাস রওনা হল; এবার পার হতে হবে মানালী-লেহ সড়ক পথের দ্বিতীয় উচ্চতম গিরিপথ লাচুলুংলা পাস, উচ্চতা ১৬,৬১৬ ফুট। হুইস্কি নালা পেরিয়ে এক সময় পার হয়ে গেলাম লাচুলুংলা পাস কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারনে বাস এখানে থামল না। আমি অবিশ্যি কনডাকটরকে নাকিলাতেই বলেছিলাম লাচুলুংলা পাসে থামাতে, ওনারা অবাক হয়ে জায়গাটার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে, কিন্তু এখানে জানাতেও থামল না, এটা নাকি ওদের দ্রষ্টব্য তালিকা ভুক্ত নয়। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া চিরে আমাদের বাস এগিয়ে চলেছে, জানালা খোলার জো নেই একে ঠান্ডা হাওয়া তায় প্রচুর ধুলো।

এরপর অল্প কিছু সময় পরে প্যাঙ্গ গিয়ে পৌঁছালাম। এখন রাস্তা দুই খাড়াই পাহাড়ের নিচে ছোট জল ধারার (না নদী?) গায়ে গায়ে। বেশ বিপদজনক একটা ওয়াটার ক্রসিং পেরিয়ে গেলাম, জায়গাটার নাম কাংলাজাল। অদ্ভুত দর্শন সব পাহাড় পেরিয়ে চলেছি। পাহাড়ে কালো কালো ডোরা, আঁকি বুঁকি, এ যেন পাহাড় নয়, সৃষ্টিকর্তা নিজের খেয়ালে পাহাড়ের গায়ে অপরূপ রূপমাধুর্য সৃষ্টি করেই চলেছেন। চারদিকের পাহাড় বড়ই একে অপরের কাছাকাছি, কখনও নদীর এই পাড়ে চলেছি তো এখন নদীখাতের পার হয়ে অন্য পারে যাচ্ছি। পথে একটি ব্রীজ পার হয়ে দেখতে পেলাম পাহাড়ের তীব্র হাওয়ায় ঘষা লেগে লেগে পাহাড়ের গায়ে একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি গর্ত, অভিযাত্রীরা ভালবেসে এর নাম দিয়েছে ইন্ডিয়া গেট


প্যাঙ্গ 

কিছুক্ষন বাদেই পৌঁছে গেলাম প্যাঙ্গে, উচ্চতা ১৫,৭৬৮ ফুট। এখানেই পৃথিবীর উচ্চতম ট্রানজিট ক্যাম্প, ভারতীয় সেনাবাহিনীর। আছে একটা মিলিটারি মেডিক্যাল ক্যাম্পও। এখানে আমাদের লাঞ্চের বিরতি। দেখি সারিবদ্ধ তাঁবু, খাওয়া বা রাত্রিবাসের সুবিধা যুক্ত। বাস যাত্রী সকলেই হাত মুখ ধুয়ে ঢুকে পড়লাম একটা তাঁবুর ভিতরে। এখন চা বা কফি খেতে মন চাইছে না, দুপুর প্রায় সওয়া দুটো; ম্যাগীর অর্ডার দিলাম, মূল্য ত্রিশ টাকা মাত্র। কোনও রকমে তাড়াতাড়ি শেষ করলাম। নিকটেই দেখি একটি টিউবওয়েল, কাছাকাছি একটা নদী আছে বটে কিন্তু নদী খাত হাজারখানেক ফুট নিচে, মাটিও রুক্ষ সামান্যই ঘাস বা গুল্ম জাতীয় তৃণ দেখা যাচ্ছে; এখানে হাতল ধরে টানাটানি করলে জল উঠবে কী(?), এই সন্দেহ মনে নিয়ে, ড্রামের ধরা জল খরচ করে হাত ধুয়ে, তাঁবু মালকিনের বাচ্চাকে আদর করে বাসে উঠে পড়লাম। শুধু মাত্র সন্দেহ নিরসনের জন্য এত উচ্চতায়, এত খাটুনির প্রয়োজন নেই। দেখি তাঁবুর মাথায় একটা পাহাড়ি ময়না পাখী বসে আছে, এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও কয়েকটা। সবাইকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের বাস।

যদিও মানালী-লেহ সড়কে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সর্বদাই অনুভুত হচ্ছে কিন্তু মিলিটারী কনভয় বিশেষ চোখে পড়ল না। এক অভিযাত্রী এবং হোমিওপ্যাথী ডাক্তার নির্মাল্যদার পূর্ব নির্দেশ মত চকোলেট চিবিয়ে চলেছি আর দশ-পনের মিনিট অন্তর দু-তিন ঢোঁক জল খেয়েই চলেছি সেই কাল দুপুর থেকে আর নিয়মিত বাথরুম করেই চলেছি সমস্ত যাত্রা বিরতিতে।


মোরে প্লেনস্ (সমভূমি)

কিছুক্ষনের মধ্যেই ঢুকে পড়লাম মোরে প্লেনস্এর সমভূমিতে। প্রায় বিয়াল্লিশ কিলোমিটার বিস্তৃত সমতল ভূমি। পুরো রাস্তা সমুদ্রতল থেকে মোটামুটি ১৫,৮০০ ফুট উঁচুতে। এত উচ্চতায় এত দীর্ঘ সমতলভূমি আছে ভেবেই অবাক লাগছিল। আমাদের বাঁ দিকে জাঁসকার পর্বতশ্রেনী এবং ডান দিকে হিমালয় পর্বতশ্রেনী। কিছুক্ষন বাদে হিমালয় পর্বত হারিয়ে গিয়ে লাদাখ পর্বতশ্রেনীর অন্যতম উঁচু তথা মানালী-লেহ গিরিপথের উচ্চতম গিরিবর্ত্ব তাংলাংলা পাস। একটা পিচের রাস্তা আছে বটে তবে সেটা একদমই ভাঙাচোরা, মাঝেমধ্যেই রাস্তা ভেঙে বড়সড় গর্ত হয়ে গিয়েছে। ছোট ঝোপগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ এখানে ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে। এইচ.পি.টি.ডি.সি., লেহর ম্যানেজার এখানে বাসের চালনার দায়িত্ব নিয়ে পিচের রাস্তা থেকে মাটিতে আগের ট্রাক বা অন্য ভারি গাড়ি চলার ফলে যে পঁচিশ-ত্রিশ খানা রাস্তা তৈরি হয়েছে তার একখানা ধরে ছুটতে লাগল। মাঝে মাঝে রাস্তা সুমখেল লুংপা নামে এক নদীর পাশ দিয়ে চলেছে। তাংলাংলার দশ কিলোমিটার আগেই ডেবরিং বলে এক জায়গায় রাস্তা সো- কার লেক হয়ে সো মোরিরি লেক চলে গিয়েছে, কিন্তু সে পথে গেলে অনুমতি নিতে হয় লেহর ডি.সি., অফিস থেকে এবং আমাদের আপাতঃ গন্তব্যর মধ্যেও নেই। মাঝে কিছু স্থানীয় নোম্যাডরা গাড়ি দেখে পানীয় জল চাইতে এসেছিল কিন্তু আমরা কেউই অত সহৃদয় হতে পারলাম না। আদতে জায়গাটা মালভূমি এবং মরুভূমিও বটে; মাঝে মাঝে রাস্তা সুমখেল লুংপা নামে এক নদী খাতের পাশ দিয়ে চলেছে বটে কিন্তু জল বিশেষ দেখতে পেলাম না। নোম্যাডদের অতদুর গিয়ে জল খুঁজতে গেলে আর দেখতে হবে না, কিন্তু তা না করেই বা উপায় কী? আমরা সবাই মিনারেল ওয়াটারের বোতল ওদের জন্য ব্যয় করবার মত উদার নই। মানালী থেকে হোটেলের জলই ওদের জন্য কেন নিয়ে আসলাম না আফসোশ হতে লাগল।


তাংলাংলা পাস

মোরে প্লেনস্ শেষ করে রাস্তা এবার দ্রুত উপরের দিকে উঠতে লাগল তাংলাংলা পাসের দিকে। এবার যেন বুকে একটা কষ্ট অনুভব করতে লাগলাম। অনিয়মিত খাওয়াদাওয়াতে বায়ু উর্ধমুখি হয়েছে ভেবে বেশ খানিকটা জল খেয়ে ফেললাম। ঘুরতে ঘুরতে বাস উঠতে লাগল, এক সময় দেখি সামনে একটা গোল দুরত্ব লেখা বেদী আর বাঁ দিকে একটা মন্দির। বুঝতে পারলাম তর্কযোগ্য ভাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম মোটরযান চলাচলকারী গিরিপথ তাংলাংলা পৌঁছে গিয়েছি। জায়গার উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ১৭,৫৮২ ফুট, একটা মাইলফলক তার জানান দিচ্ছে। সময় প্রায় সওয়া পাঁচটা বাজে, তাই আলো যথেষ্টই আছে।

বুঝতে পারলাম প্রত্যেকটা পদক্ষেপ নিতে গিয়ে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল, জানিনা সেটাই কারন কী না, আমার মাথায় যন্ত্রণা হতে লাগল। সাধারনতঃ, আমার মাথা ব্যথা হয় না। বুকে ব্যাথা তো আরও একটু আগে থেকেই হচ্ছিলই। উপসর্গগুলি অনুভব করে স্পষ্ট উপলব্ধি হল আমাকে উচ্চতাজনিত অসুস্থতা ধিরে ধিরে গ্রাস করছে। দু-একটা ছবি আগেই নেওয়া হয়ে গিয়েছিল তাই বাথরুম সেরে ধিরে ধিরে বাসে উঠে একটু চোখে মুখে জল দিলাম, দু ঢোঁক জল খেয়ে একটা চকোলেট চিবতে চিবতে পুশব্যাক সিটটাকে সামান্য একটু পিছিয়ে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিলাম। নির্মাল্যদার(ডাক্তার) উপদেশ অনুসারে বড়বড় নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলাম। বাস চলতে শুরু করল, সবদিক তাকিয়ে দেখি কেউ তাকিয়ে নেই সবাই চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম করছে এবং একজন মহিলা জানালা দিয়ে বমি করছে। কিছুক্ষন পরেও খুব একটা উপশম হল না। চোখ বন্ধ করে শরীরকে হেলিয়ে রেখেছি, মাঝেমাঝে তাকাচ্ছি বটে কিন্তু রুক্ষ ধূসর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ক্যামেরাবন্দী করতে মন চাইলেও, শরীর চাইছে না।

এভাবেই প্রায় বত্রিশ কিলোমিটার এগিয়ে এক সময় এসে পড়লাম রুমসে, উচ্চতা প্রায় সাড়ে তের হাজার ফুট। স্বাভাবিক ভাবেই বেশ খানিকটা ভাল লাগছিল কিন্তু শরীর বিশ্রাম চাইছিল। রাস্তার অবস্থাও তথৈবচঃ, ভাঙাচোরা রাস্তা কিন্তু যত এগোচ্ছি তত লালচে রুক্ষ মরু প্রান্তরে সবুজাভ আভা বাড়তে লাগল। বেশ কিছু ঘর মিলে একটা গ্রাম মত, প্রত্যেক পরিবারের জমির সীমানা পাথরের দেওয়াল দিয়ে নির্দিষ্ট করা আছে। কিছু গাছও আছে (পপলার হবে) কোথাও বাগানের মত, কোথাওবা বিক্ষিপ্ত ভাবে। আরও এগিয়ে চললাম। এক সময় একটা দেওয়াল ঘেরা সরকারী কোনও অফিসের সামনে এসে থেমে গেল বাস, একটা চেকপোষ্ট মত আছে। কনডাকটর কিছু কাগজ নিয়ে দৌড়ে যাত্রীদের তথ্য আদান প্রদান করে সামান্য পরেই আবার ছুটে ফেরৎ এসে নোটের তাড়া গুনতে গুনতে আবার ভিতরে ঢুকে গেল (নিশ্চিত ভাবেই টোল ট্যাক্স দিতে)। এবার গেটের প্রহরীর হাতে একটুকরো কাগজ গুঁজে দিয়ে কনডাকটর দৌড়ে বাসে উঠে পড়ল ও বাস ছেড়ে দিল।


সিন্ধু নদী ও উপসী

এরপর হঠাৎই এক নদীর সাথে দেখা, কনডাকটর আমাদের জানাল এটিই ইতিহাসখ্যাত ইন্দাস বা সিন্ধু নদ। কত সভ্যতা না জানি এর তীরে গড়ে উঠেছে। বেশ নষ্টালজিক হয়ে পড়লাম। সিন্ধু ব্রীজ পার হয়ে আমরা প্রবেশ করলাম উপসিতে। একটা ছোটো শহর মত, উচ্চতা ১১,১৫৪ ফুট। অনেক গুলি দোকানপাট, হোটেল, গাড়ি সারাইয়ের জায়গা দরকারি অনেক কিছুই আছে। একটা প্রার্থনা চক্র আছে। এখানে রাস্তা দু-দিকে চলে গিয়েছে, ডানদিকে রাস্তা চুমাথাং হয়ে সোমোরিরি হ্রদের দিকে চলে গিয়েছে ও সোজা রাস্তা কারু, থিকসে, শ্যে, চোগ্লামসার হয়ে লেহ শহরে চলে গিয়েছে, দুরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার মত।

একটা চা-এর দোকানে গিয়ে বসে জল খেলাম ও মুখে একটু জল ছিটিয়ে দিলাম। বেশির ভাগ মহিলা যাত্রীই বমি করতে লাগল। এখন শরীর অনেকটাই ঝরঝরে লাগছে। চা অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই চা দিল এবং এই ভ্রমণের সব থেকে তৃপ্তি করে চা এখানেই পেয়েছিলাম। মানালী বলুন বা অন্য কোথাও চা খেয়ে ভাল লাগেনি কিন্তু এখানে ভাল লাগল। বাসে এতক্ষন দশ বা পনের টাকা দিয়েই চা খেয়ে এসেছি, সে তুলনায় এটা সস্তা মাত্র সাত টাকা।

বাস ছেড়ে দিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। এরপর চওড়া ও মসৃন রাস্তা। আমাদের বাস যে জোরেও ছুটতে পারে এতক্ষনে বোঝা গেল। বাস সাঁ সাঁ করে এগিয়ে চলেছে, আবছা আলো আঁধারীতে দেখছি মাঝে মাঝে ছোট ছোটো গ্রামকে পাশে ফেলে রেখে আমরা এগিয়ে চলেছি। পাশে সিন্ধু নদে বাঁধ দিয়ে শহরের ধার দিয়ে ছোট খাল কেটে, পাড় বাঁধিয়ে, শীতের সময়টুকু জল জমে বরফ হওয়া বাদ দিলে, বছরভর জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে চাষ আবাদ সব এই জমানো জলের উপর ভরসা করেই করা হয়, লেহ শহরের প্রায় সব সবুজ আনাজপাতি এই ক্যানালের উপর ভরসা করেই উৎপাদন হয়।


লেহ্ পৌঁছে হোটেল খোঁজা 


প্রায় সওয়া নটা নাগাদ আমাদের বাস নতুন বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছাতেই আমাদের প্রায় দুই দিন ব্যাপী মানালী-লেহ বাস যাত্রার ইতি ঘটল। একে একে সবাই নেমে এলাম, ড্রাইভার দ্রুততার সাথে বাসের মাথায় উঠে সবার মাল-পত্র একে একে নামিয়ে দিল। আমি লাগেজ নিয়ে বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এক টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করতে গেলাম, কয়েকটা দোকানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। গিয়ে বিপত্তি, ফোনে কানেকশন পেলেও ওয়ান-ওয়ে হচ্ছে। আমি ওপারের কথা শুনতে পেলেও আমার কথা ওদিকের কেউ শুনতে পাচ্ছে না। দু-তিন বার চেষ্টা করেও হল না। এদিকে সেই অর্থে থাকার জায়গা ঠিক করা নেই।

আগে এক লাদাখের টুরিষ্ট এজেন্ট নীতুজি / শেরিং দোরজের (ফোনঃ ০৯৪১৯১৭৮৩১৯/ ০৯৯০৬৯৮৫৫৯৪) মাধ্যমে লেহ শহরের অদূরে চুবি-তে ওম্যান অ্যালায়েন্স অফিসের সামনে রি-ইয়র্ক গেষ্ট হাউসে প্রাথমিক কথা হয়েছে কিন্তু ঘর বুক করা হয়নি, ওদের ফোন নাম্বারও কাছে নেই। নীতুজি কে ফোন করলাম, উনি বললেন কথা বলা আছে, ট্যাক্সি নিয়ে চলে যেতে, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমরা মাত্র দু-দিন থাকব বলাতে উনি বললেন কাছাকাছি কোথাও থাকার চেষ্টাও করতে পারি, উনি শহরের বাইরে আছেন একটু বাদে সিগন্যাল অফ হয়ে যাবে কিছু একটা সিদ্ধান্ত তাড়াতাড়ি নিতে, কারন এরপর ট্যাক্সি পাওয়া শক্ত হবে। এমন সময় লাইনটাও কেটে গেল, এতক্ষন লোডশেডিং চলছিল এবার আলো এল; আর কিছুতেই কানেকশন পাই না।

বাইরে বার হতেই একজন যুবক হিন্দীতে বলল থাকার জন্য হোটেল বা গেষ্ট হাউস লাগবে কী না। আমি তার কথা প্রায় লুফে নিয়ে বললাম হ্যাঁ। উনি বললেন কি-রকম দামের চাই? বললাম, বেশি দাম নয়, কিন্তু শহরের মধ্যেই, ডাবল বেড, অ্যাটাচড বাথরুম সহ পরিস্কার হোটেল বা গেষ্ট হাউস হলেই হবে। ছেলেটির নাম স্টানজিন (০৯৯০৬৯৯০৭০৩), বলল সাড়ে তিন থেকে চারশো টাকার মধ্যে হলে চলবে। সম্মতি জানাতে বলল, তাহলে ও ট্যাক্সি ডেকে আনছে, একশ টাকা লাগবে সেজন্য, কয়েকটা দেখাবে তার মধ্যে থেকে একটা বেছে নিতে।

স্টানজিন উধাও হয়ে গেল আর মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটা মারুতি ভ্যান নিয়ে হাজির হল। আমরা মাল-পত্র নিয়ে ওর পেটের ভিতর সেঁধিয়ে পড়লাম। একটু ঘুরপাক খেয়ে আমরা চলে এলাম জ্যাংস্তিতে, আপার তাকচা রোডে একটা ছোটো কালভার্টের আগে বাঁ হাতে গলিতে রি-ইউল গেষ্ট হাউস। ভাড়া মিটিয়ে একটু দাঁড়াতে বলে ঢুকে পড়লাম। স্টানজিন নিজেই চাবি নিয়ে এসে নিচের তলার বত্রিশ নম্বর ঘরে আমাদের নিয়ে এল। বলল ভাড়া চারশো টাকা। ঘরটা মোটামুটি, পরিষ্কার সাদা বিছানা, অ্যাটাচড বাথরুম, মেঝেতে কার্পেট সবই আছে কিন্তু ঘরে টিভি নেই ও আলো বড়ই টিমটিম করে জ্বলছে। বলাতে জানাল লেহ-তে ইলেকট্রিসিটির বড়ই অভাব, বেশির ভাগ সময়ই থাকেনা ও থাকলেও লো-ভোল্টেজ। জেনারেটর দু-খানা আছে বটে কিন্তু তার একখানা খারাপ হয়ে গিয়েছে, সারিয়ে আনতে পরের সপ্তাহ। তাই লোডশেডিং-এ আলো জ্বলবার সম্ভাবনা কম, ও প্রয়োজনে চালাতে বলে দিচ্ছে।

আমার পছন্দ হয়ে যাওয়াতে ও বলল তিন রাতের জন্য আর অ্যাডভান্স করতে হবে না, যাবার সময় দিলেই হবে। এও বলল, ও পারমিট এবং শেয়ার গাড়ির ব্যবস্থা কাল করে দেবে, একটা ফোন করলেই হবে এছাড়া বাইরে দাঁড়ানো অমনিকে (গাড়ী) যেতে বলে দিচ্ছে - এই বলে বিদায় নিল। আমি ওর দক্ষিনা দিতে যেতে বলল ও দালাল নয়, এটা ওর দিদির গেষ্ট হাউস।

আমি ভয়ঙ্কর ভাবেই ক্লান্ত। কোনও রকমে হাত-পা-মুখ ধুয়ে, পোশাকের পরিবর্তন করে বিস্কুট ও জল খেয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। পাশ দিয়ে একটা খাল গিয়েছে, বেশ খরস্রোতা, জল প্রবাহর শব্দ হচ্ছে। সময় প্রায় সাড়ে দশটা হবে, আলো নিভে গেল, লোডশেডিং। টর্চ বালিশের পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।


বাথরুম বিপত্তি

যদিও কোনও বাঁধা ধরা প্ল্যান নেই তবুও উঠে পড়লাম সকাল ছটায়, আজ শনিবার। ডাক দিলাম গেষ্ট হাউসের কেয়ারটেকার সন্তোষকে, একটা বালতি নিলাম। গরম জলের ব্যবস্থা করতে বললাম; তৈরিই ছিল। ইলেকট্রিক এখনও নেই। উঠে সকালের সব অবশ্য কর্তব্য এবং স্নান সারতে গিয়ে মহা বিপত্তি। গরম জলের কলের হাতল ঘুরিয়ে খুলতে গিয়ে, হাতলটা হাতে খুলে এল। গরম জলের স্রোত তীব্র বেগে বাথরুমের দরজায় এসে পড়ছে। হাত দিয়ে থামাতে পারছি না, দরজা খুললে বিছানায় এসে পড়বে; গামছা দিয়ে কোনওরকমে আটকে আমি চিৎকার করে সন্তোষকে ডাক দিয়ে কল উপর থেকে বন্ধ করতে বললাম। ও উপরের গরম জলের মূল সংযোগ বন্ধ করে দিল এবং গেষ্ট হাউসের মালিককে ডেকে নিয়ে আসল। মিস্ত্রি এসে ঠিক করতে করতে প্রায় নটা বেজে গেল। ঘরের অবস্থা ভাল নয়, এত মানুষের জুতায় ধুলো ও জলে কাদা কাদা হয়ে গিয়েছে। সন্তোষকে ঘরের চাবি দিয়ে একটু পরিষ্কার করতে বলে খেতে বার হলাম; ফোন করে বাড়ির সংবাদ নিতে হবে।

আপার তাকচা রোডে একটা ফোন বুথে চেষ্টা করলাম কিন্তু লম্বা লাইন দেখে অন্য জায়গার খোঁজে এগোলাম। আগে একটা গলিতে ছোট রেস্তোরা থেকে মাত্র কুড়ি টাকায় চারটে চাপাটি, আচার সহযোগে খেয়ে পেটের জ্বালা জুড়ালাম। এরপর ফোনের বুথে জন্য খুঁজতে বার হলাম অনেক খুজে একটা বুথের খোঁজ পেলাম একটা মার্কেট কমপ্লেক্সে। প্রথমে বাড়ির খবর নিয়ে ফোন করলাম মানালীতে আমাদের হোটেলে এবং এইচ.পি.টি.ডি.সি., মানালীতে। জানতে পারলাম আবার লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে মানালী ও সংলগ্ন এলাকায়। যদি আমার ফেরা গড়বড় হয় তাই ভাবলাম বেশি দেরি না করে এইচ.পি.টি.ডি.সি., লেহর অফিসে গিয়ে পরশুর ফেরৎ যাবার টিকিট কেটে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হাজির হয়ে গেলাম র্ফোট রোডের এইচ.পি.টি.ডি.সি. অফিসে। কেটে ফেললাম পরশুর ফেরত যাবার টিকিট, ওদের তার পরের দিন বাস সার্ভিস নেই। স্টানজিন-কে বা নীতুজি-কে ফোন করবার অনেক চেষ্টা করে না পেয়ে হতাশ হলাম। এখানে ফোনে সময় মত যোগাযোগ করতে ভাগ্যর সাহায্য দরকার।


পারমিট ও প্যাংগং-এর শেয়ার গাড়ী জোগাড়

ততক্ষনে সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে, দিনটা নষ্ট করলে হবে না। কাল আসতে আসতে ভেবেছিলাম সকালে পারমিট বানিয়ে দুপুরের আগে খারদুংলা গিয়ে ফেরৎ আসব কিন্তু এখন কালকের প্যাংগং লেক যাবার শেয়ারে কোনও গাড়ি পাচ্ছি না। হঠাৎ দেখি ভির্গো ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর অফিসে একটা কাগজ আছে দুজন প্যাংগং লেক যাবার ইচ্ছুক সহযাত্রী চাই, একজন স্প্যানিশ পরিবারের সাথে। যোগাযোগ করলাম বলল দুপুর বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে নিশ্চিত হবার জন্য, টাকা তখন দিলেই হবে। আমার অত বাছার সময় নেই, কিন্তু খারদুংলা যাবার প্ল্যান মাটি। লাদাখ ঘুরতে গিয়ে বুড়ি ছুয়ে আসতে হচ্ছে। ফেরার যা প্ল্যান (ট্রেনে), তাতে কোনও কারনে একদিন আটকে গেলে ফেরত যাবার টিকিট পাব না।

এবার ভাবলাম, অন্য জায়গায় চেষ্টা করা যাক যদি এখানে না হয়। সেই মত ইয়াক ট্রাভেলস-এ সহযাত্রী চাই বোর্ড দেখে ভির্গো ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস-কে বাতিল করে একশ টাকায় পারমিট ও এক হাজার বত্রিশ টাকায় প্যাংগং লেক ঠিক করলাম। আমাদের পারমিট পেতে বিকাল হয়ে যাবে তাই খারদুংলা যাবার প্ল্যান ভুলতে হল। আমার মূল দুই লক্ষ্যর একটা বাতিল করতে বাধ্য হলাম কিন্তু সামনাসামনি দ্রষ্টব্যস্থানগুলি ঘুরে আসা উচিত। একটু ঘুরপাক খেয়ে গ্লেসিয়ার ট্রাভেলসের থেকে এক হাজার টাকায় একটা গাড়ী ঠিক করলাম। ঠিক একটায় রওনা হলাম অবশ্য তার আগে সেই ছোট্ট হোটেলটায় দুপুরে খাবার ভাত, রুটি, ডাল, দু-রকম তরকারি ও ট্যোমাটোর চাটনি দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকায় খেয়ে নিয়ে গ্লেসিয়ার ট্রাভেলসের সামনে থেকে একটা নতুন ওয়াগনারে সওয়ারী হলাম।


ইন্দাস-জাসকার সঙ্গমস্থল

প্রথমে গেলাম ইন্দাস ও জাঁসকার নদীর সঙ্গমস্থলে। যাত্রাপথ বেশ চমৎকার, লেহ-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক ধরে নিম্মো পর্যন্ত আসতে হয়। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা, কোনও কোনও পাহাড়ের মাথায় বরফ। সেনাবাহিনীর জওয়ান এবং গাড়ীর একটু দৃষ্টিকটু ভাবে বেশি উপস্থিতি কিন্তু কিছু করবার নেই, সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গা। এখানেই দক্ষিন-পূর্ব দিক থেকে আসা হাল্কা সবুজাভ ইন্দাস (সিন্ধু) দক্ষিন-পশ্চিম দিক থেকে আসা ঈষৎ ঘোলা জলের জাঁসকার নদীর সাথে মিশে উত্তর-পশ্চিমে ইন্দাস নামে বয়ে এক সময় পাকিস্তানে চলে গিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য, ঘণ্টার পর ঘন্টা এখানে বসে থাকা যায়। একটা অ্যাডভেঞ্চার সন্ধানি দল সিন্ধুতে জাঁসকারে রাফটিং সেরে নামল। আমি সিন্ধুর হিমশীতল জলকে একটু ছুয়ে নিলাম, ইতিহাসের সাক্ষী হবার জন্য। এবার পরবর্তী গন্তব্যস্থল ম্যাগনেটিক হিল, সামান্যই দুরে (গাড়ীতে)। একটা বেশ তোরণের মত পাথরের পাশ দিয়ে এগিয়ে চললাম। এই রুক্ষ প্রান্তরে দুরে একরাশ সবুজ গাছ-গাছালি। আরও এগোলাম, উপরের থেকে সঙ্গমস্থলের দৃশ্য আরও বেশি মনমুগ্ধকর, নেমে ছবি নিলাম।


ম্যাগনেটিক হিল

এসে পড়লাম ম্যাগনেটিক হিলে। লেহ-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক এখানে দুই পাহাড়ের ঠিক মাঝখান দিয়ে শ্রীনগরের দিকে চলে গিয়েছে। ধু ধু করছে মরু প্রান্তর কেউ কোথাও নেই, মাঝে মাঝে উপত্যকার নিঃস্তব্দতাকে খানখান করে বিশালাকায় ট্রাকের সারি হর্ন বাজিয়ে আমাদের সর্তক করে এগিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রবাদ আছে, এখানে রাস্তায় বক্স আঁকা জায়গায় গাড়ীকে নিউট্রালে রাখলে বা গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ রাখলে গাড়ী ঢালের বিপরীত দিকে গড়াতে শুরু করে, সম্ভবতঃ এখানে কোন অতি চুম্বকীয় ক্ষেত্র সক্রিয় আছে। আমাদের চালককে অনুরোধ করাতে সেও একই খেলা দেখাল। রাস্তার বাঁ দিকে একটা ছোট মন্দিরও আছে এবং ডান দিকে ম্যাগনেটিক হিল লেখা সাইন বোর্ড।


গুরুদোয়ারা পাথর সাহিব

এবার চলে এলাম গুরুদোয়ারা পাথর সাহিব, নানক হিলের গায়ে এই পবিত্র ধর্মস্থান। এখানে শিখ ধর্মগুরু গুরুনানক কে নিয়ে এক উপকথাকে ভিত্তি করে এই মন্দির গড়ে উঠেছে। কথিত আছে, গুরুনানক যখন ১৫১৭ সালে তিব্বত থেকে এই রাস্তা হয়ে ফেরার সময় প্রার্থনা করছিলেন, তখন এক রাক্ষস নাকি পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে কিন্তু পাথর গড়িয়ে পড়বার পর দেখা যায় গুরুনানক বহাল তবিয়তে প্রার্থনা করছেন; পাথরটি ওনার গায়ে লেগে ওখানেই থেমে গিয়েছে এবং নানকের দিকে পাথরটি মোমের মত ওনার শরীরের ছাচের আকার নিয়েছে। পরে সেই রাক্ষস গুরুনানকের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে ওনার পরমভক্ত হয়ে যায়।


স্পিতুক গোম্ফা

ওখান থেকে চলে এলাম স্পিতুক গোম্ফায়। এটি একাদশ শতাব্দীতে তৈরি হয়। পাহাড়ের গায়ে অসাধারন সুন্দর এই গোম্ফাটি অবশ্যই দেখা উচিত, যদিও সময়াভাবে বিশেষ কোথাও যাওয়া হয়নি তবুও এই জায়গা থেকে লেহ শহরের এবং সংলগ্ন অঞ্চলের একটা অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আরও কিছুটা উপরে আছে মহাকালের মন্দির। একটু কষ্ট করে সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়। একটা বিশাল কালী মূর্তি আছে, আবছা আলোয় দেখলেই মনে ভয়ের উদ্রেক হয়। এখানে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। মহাকালের মন্দির এবং স্পিতুক গোম্ফায় কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে এলাম পরবর্তি গন্তব্যস্থলে।


হল-অফ-ফেম

স্পিতুক গোম্ফার অদুরেই ‘হল–অফ–ফেম’, কুড়ি টাকার টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। এখানে ছবি তোলা নিষিদ্ধ নয়। ভিতরে লাদাখের মানুষের জীবন যাত্রা, রাজাদের ইতিহাস, এখানের জীব-জন্তু, লাদাখের পর্বতশ্রেনীর একটা ক্ষুদ্র সংস্করন, লাদাখে আমাদের ভারতীয় সেনা বাহিনীর বীরত্বের ইতিহাস এবং সেনাদের যুদ্ধে ব্যবহৃত সাজ-সরঞ্জাম, শত্রু বাহিনীর থেকে দখল করা অস্ত্র ইত্যাদি আছে। ঘুরতে ঘুরতে ভারতীয় হিসাবে গর্ব এবং বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। মূল ভবনের পিছনে একটি শহীদ স্মরণে স্মৃতিসৌধ আছে তার পিছনের পাহাড়ের চাদর মুড়ে একটা অনন্য সুন্দর আবহ তৈরি করেছে।

এরপর লেহ শহরে ফিরে গাড়ি ছেড়ে দিলাম এবং ইয়াক ট্রাভেলস থেকে পারমিট সংগ্রহ করলাম। এরপর খাবার জল কিনে গেষ্ট হাউসে একটু পরেই হাত-মুখ ধুতে চলে এলাম, সময় প্রায় বিকাল ছটা (উত্তর ভারতে সন্ধ্যা হতে প্রায় সাড়ে সাতটা-আটটা বেজে যায়)। এখন অবশ্য ইলেকট্রিসিটি আছে, তাই কালবিলম্ব না করে ক্যামেরার ও মোবাইলের ব্যাটারী চার্জ দিতে বসালাম।


শান্তি স্তূপ

একটু গড়িয়ে নিয়ে সাড়ে ছটা নাগাদ বের হয়ে ফোন বুথ থেকে বাড়িতে একটু সংবাদ নিয়ে দুশ টাকায় একটা ট্যাক্সি নিলাম শান্তি স্তূপ যাওয়াআসার জন্য। সাতটা নাগাদ শান্তি স্তূপে পৌঁছে গেলাম। এটা ১৯৯১ সালে জাপানী বৌদ্ধ ভিক্ষু গিয়োমো নাকামুরা তৈরি করেন। জায়গাটি ভ্রমনার্থীদের কাছে কেবলমাত্র শুধু এর স্থাপত্যর জন্য বা বৌদ্ধ ধর্মের একটি পীঠস্থান বলেই অতন্ত্য জনপ্রিয় নয়; এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারন এখান থেকে পুরো লেহ শহর দেখা যায়, লেহ্-র প্যানোরামিক দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করা যায়। নিঃসন্দেহে সন্ধ্যা বেলাই এই মনমুগ্ধকর নৈসর্গ উপভোগ করবার শ্রেষ্ট সময়, পড়ন্ত বেলার সূর্য শান্তি-স্তূপকে অসম্ভব মায়াময় করে তুলেছে।

এরকম একটা পরিবেশ ছেড়ে আসতে মন চায় না কিন্তু নেমে আসতেই হল, কালকে প্যাংগং লেক যাব। সকালে উঠে তৈরি হতে হবে তাই খেয়ে দেয়ে একটু আরামের প্রয়োজন আছে বৈকি। গত বৃহস্পতিবার থেকে খালি দৌড়েই যাচ্ছি। এরপর সেই গলির ছোট্ট হোটেলটায় গিয়ে রাত্রের জন্য এক প্লেট ভেজিটেবল মোমো (দশটা বড় পিস্) পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে খেয়ে ফেললাম। টাকনা দেবার জন্য চাটনি যুতসই ছিলনা তাই অত ভাল লাগল না। বলাই বাহুল্য পরীক্ষা-নিরিক্ষার জেরে রাত্রের খাওয়া এক প্রকার মাটি হল, তৃপ্তি হল না। এরপর ঘরে এসে জামা-কাপড় বদলিয়ে, পরের দিনের অ্যালার্ম ভোর চারটে-তে দিয়ে সটান ঘুম দিলাম।


ভোর চারটেয় অ্যালার্ম শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম আজ রবিবার, প্যাংগং লেক যাব। সন্তোষকে ডেকে এক বালতি গরম জলের ও আগে এক কাপ করে গরমাগরম চা-এর ব্যবস্থা করতে বললাম। ও পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চা করে আনল এবং সাড়ে চারটে নাগাদ আস্ত এক বালতি গরম জল আনল। আমি দ্রুততার সাথে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। এত সকালে খাবার আর কী বা পাব সাথে বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদি ছিল, সেগুলো বেশ খানিকটা পেটে পুরে নিলাম, কিছুটা সাথেও নিলাম। একটা অ্যাভোমিন গলাধঃকরন করে রওনা হয়ে গেলাম।

সকাল ছটা পনের মিনিটে ইয়াক ট্র্যাভেলসের সামনে আমার অপেক্ষা করবার কথা, সেই মত ছটা পাঁচ মিনিটে গেষ্ট হাউস ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম যদিও পৌঁছাতে দু-তিন মিনিটের বেশি লাগবার কোনও কারন নেই। রাস্তায় বেশ কয়েকটা তাগড়াই কুকুর ঘেউঘেউ করছিল, আমার কুকুরে বিশেষ ভয় নেই, তাই ওদের পাস কাটিয়ে এসে দেখি সব ভোঁ-ভা; কেউ কোথাও নেই। ঠিক ছটা কুড়ি মিনিট নাগাদ একটা স্করপিও হাজির হয়ে গেল, ড্রাইভার সমেত মোট ছজন ঠিক সাড়ে ছটা নাগাদ রওনা হয়ে গেলাম।


কারু, শক্তি হয়ে চ্যাংলা পাস

কিছুক্ষন চলার পর আমাদের গাড়ি কারুতে থামল। এখানে রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে, বাঁ দিকে চলে গিয়েছে প্যাংগং লেক যাবার রাস্তা এবং ডান দিকে উপসি, তাংলাংলা ইত্যাদি হয়ে হিমাচল প্রদেশের কেলং, মানালি বা কাজা চলে গিয়েছে। আমাদের এখানে ব্রেকফাস্টের বিরতি, প্রায় সবাই আলু-পরোটা খেতে লাগল আমি এক পেয়ালা চা খেয়ে নিলাম। গাড়ী আবার চলতে লাগল, আমরাও গাড়ীর সাথে তাল দিয়ে বকবক করতে লাগলাম। পিছনে বসতে অসুবিধা হচ্ছিল, রাস্তা একদমই ভাঙ্গা, পিচের ছোয়া প্রায় নেই বললেই ভাল হয়, স্বাভাবিক ভাবেই গাড়ী লাফাচ্ছিল ও পিছনের সীটের সওয়ারী (আমি) সব থেকে বেশী লাফাচ্ছিলাম। বিশেষ করে অসুবিধা হচ্ছিল ছবি তুলতে না পারার জন্য, অবশ্য পিছনে একা থাকার ফলে আমি বেশ পা তুলে আধশোয়া হয়ে আরাম করে বসলাম।

শক্তি/শাকতি (একটি গোম্ফাও আছে) পার হবার পর একটা কঠিন চড়াই পার হয়ে এলাম জিংগ্রাল গ্রামে। এখানে পারমিট চেক করিয়ে এগিয়ে চললাম। রাস্তা খুবই খারাপ; জায়গায় জায়গায় ঝর্নার জল বয়ে গিয়ে রাস্তা খারাপ করে দিয়েছে, বাইক আরোহীদের জন্য খুবই কঠিন পথ। যত উঠছি বাতাসে ঠাণ্ডার ভাব বেড়ে চলেছে। দুরের বেগুনি সবুজ খয়েরি পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করলাম পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম মোটর চলার উপযুক্ত গিরিপথ চ্যাংলা-র উদ্দেশ্যে, উচ্চতা ১৭,৫৮৬ ফুট। বেশ খাঁড়া চড়াই রাস্তা পাহাড়ের গা কেটে করা হয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাহাড়ের গায়ের বরফ সামনাসামনি চলে এল এবং এক সময়ে এসে পড়লাম চ্যাং নামে এক সাধুবাবার স্মৃতিতে স্মৃতিমেদুর এই গিরিপথে। তাংলাংলার সাথে তুলনা করলে এখানেও শারীরিক অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু মনে হয় আমাদের শরীর এতদিনে এই উচ্চতাকে সহ্য করতে শিখে গিয়েছে।

এখানে সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল ইউনিট আছে। ভ্রমণার্থীদের এখানে সেনাবাহিনী বিনামুল্যে চা খাওয়ায়; একটি সুভ্যেনির শপ ও আছে কেনাকাটা করবার জন্য। চা-এ চুমক দিতে দিতে এক মারাঠা সৈন্য জানালেন যে সাধারণতঃ ভারতীয় জওয়ানরা পৃথিবীর উচ্চতম এবং শীতলতম যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেন হিমবাহে যাবার আগে উচ্চতা ও ঠান্ডার সাথে পরিচয় করতে কিছুদিন এখানে অতিবাহিত করে রওনা দেয়। দুধ ছাড়া চা আমার না-পসন্দ কিন্তু এই চা আমার অসাধারন লাগল; হয়ত ঠাণ্ডার জন্য অথবা প্রস্তুত করার পদ্ধতির জন্য। রাস্তার ডান দিকে বেশ খানিকটা উপরে চাংলা বাবার মন্দির।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কিভাবে তাংলাংলা পাস ১৭,৫৮২ ফুট উঁচু হয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম গিরিপথ হয়ে গেল; দুখানা পাসের (গিরিপথ) রক্ষনাবেক্ষন একই বি.আর.ও. (৭৫৩ নং) করে থাকে, তবে এই ভুল কিভাবে ওনাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে? আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম আমার পা টলছে শরীরের ভারসাম্য কম, তবে সুখের কথা তাংলাংলার মত মাথা যন্ত্রণা বা বুকে ব্যথা হচ্ছিল না। আসলে একটু বেশীই হাঁটাহাঁটি হয়ে গিয়েছিল।

এবার নামতে হবে পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে, একসময় এসে পৌঁছালাম দুরবুক। এখানে পারমিটের আর এক কপি ড্রাইভার সাহেব চেকপোষ্টে জমা দিয়ে এগিয়ে চললাম। এখানে আবার রাস্তা মোটামুটি ভালই। দুইপাশে ঢেউ খেলানো উপত্যকা। যদিও এখানে মারমট নামে এক পাহাড়ী খরগোস দেখা যায় দেদার, আমার বসার স্থানের সৌজন্যে বা কপাল গুনে কিছুই চোখে পড়লনা। আরও কিছুটা এগিয়ে তাংসে গ্রাম। এখানে দু-চারটে চলনসই খাবার হোটেল ও সস্তা গেস্ট হাউস আছে। এখন আমারা সারাক্ষণই প্রায় পনের হাজার ফুট উপর দিয়ে ছুটে চলেছি। সারাক্ষণই পরিষ্কার আকাশ ছিল তাই সমস্ত যাত্রাপথ আমরা উপভোগ করতে পেরেছি। এখানেও আবার একটা চেকপোষ্ট আছে; কি বা করা যাবে, চীন সীমান্ত এখান থেকে বিশেষ দুর নয়, আইনের বিধিনিষেধ একটু বেশি মাত্রায় থাকাটাই তো প্রত্যাশিত।


পান্না সবুজ প্যাংগং সরোবর

একটু চলার পর দেখা পেলাম বিখ্যাত পাগলা নদীর সাথে, বছর দুয়েক আগেও দুপুর দুটোর মধ্যে যাতায়াত সেরে ফেলতে হত এখান, অন্যথায় খরস্রোতা নদীর ভয়ংঙ্কর স্রোত গাড়িকে উল্টে ফেলে দিত। এখন এখানে ব্রীজ বানানো গিয়েছে। র্দুভাগ্য বা সৌভাগ্য যাই হোক না কেন, ব্রীজের কাছে গিয়ে দেখলাম নদীতে একটুও জল নেই। প্যাংগং সরোবর আর বিশেষ দুর নয়। আর কিছুটা এগোতেই দেখা গেল পাথরের গায়ে প্যাংগং-এর প্রথম র্দশনের লেখা, আরে সত্যিই তো... বাঁ দিকে একটা পান্না সবুজাভ জলরাশির হাতছানি। প্যাংগং এখান থেকে আর মাত্র চার কিলোমিটার। আবার এগিয়ে চললাম, এক ছুট দিলাম বললে ভাল হয়। একটু নীচে নেমে এলাম দু-পাশে সোনালী পাহাড়, দুপুর রোদে ঝকঝক করছে আর বাঁ দিকে এই পথের শেষ বড় গ্রাম লুকুং-কে রেখে নেড়া, গনগনে হলুদ পাহাড় আর নীল আকাশের চাঁদোয়া বিছিয়ে ইতিউতি শরতের সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, এরকমই এক মনকাড়া পটভূমিকায় এক নীল সরোবর।

১৩৪ কিলোমিটার লম্বা আর ৫ কিলোমিটার চওড়া এই নোনতা জলের প্যাংগং লেকের মাত্র ৪০ শতাংশ(%) ভারতে, বাকিটা চীনের দখলে। ১৯৬২ সালের আগে পুরোটাই আমাদের দখলে ছিল কিন্তু ১৯৬২ সালে চীন লাদাখের বেশ কিছুটা অংশ, পুরো প্যাংগং লেক সমেত দখল করে নেয়। পরে আর্ন্তজাতিক চাপের কাছে মাথা নুইয়ে লাদাখের দখলীকৃত অংশ ফেরৎ দেয় বটে কিন্তু প্যাংগং লেকের ৬০ শতাংশই নিজেদের দখলে রেখে দেয়। এ তো গেল রাজনৈতিক ভাবে ভৌগলিক অবস্থান বিশ্লেষণ কিন্তু এর বিশালত্ব এবং প্রাকৃতিক সৌন্দয্য ব্যখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

জল যে এত নীল হতে পারে আর তাতে একটা পান্না সবুজ ভাব থাকতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। যারা আমির খান অভিনীত থ্রী ইডিয়েটস্ দেখেছেন তাদের এই নীল সরোবরের একটা প্রাথমিক ধারনা আছে। গাড়ী থেকে নেমে প্রায় ছুট লাগালাম জলকে ছুয়ে দেখবার জন্য। আমি অবশ্য জুতো মোজা খুলে ফেললাম জলে পা ভেজাবার জন্য। আমার গোটানো জিন্সের প্যান্ট নিচের দিকে কিছুটা ভিজেই গেল, যাই হোক একটু জল চেখেও দেখে নিলাম, সত্যিই নোনতা। জলে শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ আছে, তাই পাড়ের কাছে জল ঘন সবুজ বটে। এত উচ্চতায় (১৪,২৭০ ফুট) অন্য উদ্ভিদ বা জলজ প্রানীর বেঁচে থাকা সম্ভবপর নয়। এরপর সবাই ক্যামেরা নিয়ে পটাপট ছবি তুলে নিতে শুরু করলাম। এখন সময় প্রায় সাড়ে এগারোটা। ড্রাইভার আমাদের জন্য মাত্র এক ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করল দেখবার জন্য এবং লেকের ধারে তাঁবুতে খাওয়া দাওয়ার জন্য।

প্রচুর লোকজন চারদিকে; গাড়ী আর মানুষের মাঝে লেকের ছবি তুলতে অসুবিধাই হচ্ছিল যেমনটা আমার জন্য বাকিদের তেমনটাই হচ্ছিল বোধহয়। যাইহোক কিছু ছবি তুললাম কিছু ভিডিও রের্কড করলাম। একদল বয়স্কা ভদ্রমহিলারা (সকলেই পঞ্চাশোর্ধ) একজোট হয়ে গাড়ীর স্টিরিও চালিয়ে তালে তালে নাচছিল, আমি ও বাকি সকলে সব ভুলে ওদের এই বয়সে সমুদ্রতল থেকে চোদ্দ হাজার ফুট উপরে চ্যাংচ্যাংমো পর্বতমালা পরিবেষ্টিত হয়ে নৃত্য উপভোগ করলাম ও করতালি দিয়ে উৎসাহিত করছিলাম। যদিও ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল কিন্তু সূর্য মধ্যগগনে আমাদেরকে প্রায় পুড়িয়ে দিচ্ছিল। তাই বিশেষ গরম পোশাকের দরকার তখন অনুভূত হয়নি।

এই লেকের ধারে পাওয়া যায় ব্রাহ্মনী হাঁস ও একধরনের পরিযায়ী পাখি। আমি এবার ভাগ্যবান দুই ধরনের পাখিই দেখা গেল। পাখি গুলি বেজায় দুষ্টু, গলা অত্যন্ত কর্কশ এবং একদমই ক্যামেরা পছন্দ করে না। আমার ক্যামেরার হাত বিশেষ ভাল নয় তাই অনেক চেষ্টার পর ওদের এক-দুটোর বেশি ছবি ক্যামেরাবন্দী করা গেল না। এরপর আমাদের ড্রাইভার সমেত একটা গ্রুপ ছবি তুললাম আর রওনা দিলাম সেই তাঁবুর দিকে। আমাদের সাড়ে বারোটায় রওনা দেবার কথা আর এখনই সাড়ে বারোটা বাজে। চটপট এককাপ চা আর ম্যাগী অর্ডার দিলাম, ভাত ফুরিয়ে গিয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চা চলে এল আরও পাঁচ মিনিট বাদে ধূমায়িত ম্যাগীর পাত্র এল। খিদেয় পেট চুইচুই করছে, সকালে বিস্কুত-চানাচুর-চা ছাড়া আর কিছুই পেটে ঢোকেনি, তাই দুটোই চটপট উড়িয়ে দিয়ে আবার লেহর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, তখন একটা দশ বেজে গিয়েছে। বলা হয়নি লেকের গা দিয়ে আরও আট কিলোমিটার দুরে স্প্যাংগমিক গ্রামে যাওয়া যায়। ওখানে থাকার ব্যবস্থা আছে; মুলতঃ তাঁবু ছাড়াও দু-একটা স্থায়ী কাঠামো আছে। আমাদের পারমিট ও বুকিং দুটোই স্প্যাংগমিক পর্যন্ত না থাকায় আমাদের অতদুর যাওয়া হল না।


লেহ-তে ফেরৎ

এবার ফেরার পালা। আমি পিছনে বসে একটু পা ছড়িয়ে আয়েস করে চোখ বুজিয়ে ক্লান্তি দুর করে নিলাম। আবার আমাদের একই পথে চ্যাংলা পাস পার হয়ে লেহ ফিরতে হবে। চ্যাংলা পাসে এসে আমি আরও এককাপ গরমাগরম চা খেয়ে নিলাম বিনামূল্যে। এরপর বাথরুম সেরে আমরা চলতে শুরু করলাম। এরপর বিশেষ আমার মনে নেই, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; ঘুম ভাঙতে দেখি আমরা ফোর্ট রোডে ঢুকে পড়েছি। চোখ রগড়ে, একটু জল খেয়ে সবাই-কে বিদায় জানিয়ে আমরা আমাদের গেস্ট হাউসের ঘরে ঢুকে একটু পরিষ্কার হয়ে নিলাম। এরপর আবার বাইরে বার হয়ে জার্মান বেকারীর বারান্দায় বসে এককাপ চা ও প্যাস্ট্রি খেয়ে নিলাম। এরপর বাড়ির সবার জন্য চামড়ার কয়েকটা হাতব্যাগ দরদাম করে কিনে নিলাম।

পরের দিন ফিরতে হবে মানালীর উদ্দেশ্যে, তাই রাস্তার হাল হকিকত এবং গাড়ীর নাম্বার জানতে এইচ.পি.টি.ডি.সি’র লেহ অফিসে গেলাম, অফিস সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। আমাকে জানানো হল যে মাত্র সাতজন যাত্রী হবার জন্য বাসের বদলে একটা ইনোভার ব্যবস্থা করা হয়েছে; এছাড়া রোটাং পাস ধ্বসে আজ দুপর থেকে বন্ধ, প্রায় ভলভোর মত এত বড় বাস কাল পরশু রাস্তা ঠিক হলেও কতটা যেতে পারবে বলা শক্ত। আমাদের পরদিন ঠিক ভোর সাড়ে চারটেয় জম্বু কাশ্মীর ব্যাঙ্কের এ.টি.এম.এর সামনে দাঁড়াতে বলা হল। আমি খাবার জল ও স্লাইস (ম্যাংগো ফ্রুট জুস) কিনে গেস্ট হাউসে ফিরৎ এলাম। একটু গড়িয়ে নিলাম।

সন্ধ্যা আটটা নাগাদ আবার রাতের খাবার খেতে সেই হোটেলটায় এসে এক প্লেট থুকপার অর্ডার দিলাম। একটু মোটা ন্যুডলস জাতীয় খাবার বেশ কিছু সবুজ পাতা সমেত। আমার মোটেই ভাল লাগল না, আমি গোলমরিচের গুড়ো ও নুন দিয়ে কোনও রকমে পেটে চালান করে গেস্ট হাউসে চলে এলাম। কাল সকালে মানালীর উদ্দেশ্যে রওনা দেব। আরামদায়ক বাস নেই, একটা ইনোভাতে ড্রাইভার বাদে সাতজন মানে যথেষ্ট কষ্টদায়ক যাত্রা। এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম এবং ঘরের ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। সাড়ে নটা নাগাদ ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।


অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙতে দেখি তখন রাত তিনটে। আজ সোমবার, গেস্ট হাউসের সন্তোষকে এত রাতে ঘুম ভাঙাতে মন চাইল না। একটু উঠে পায়চারি করতে করতে দাঁত-মুখ মেজে নিলাম। গ্লাস দুয়েক জল খেয়ে নিলাম। পাহাড়ের জলের গুন না অন্য কোনও ব্যপার বলতে পারব না, তাড়াতাড়িই প্রাতঃকৃত্য সেরে স্নান করে বাথরুম থেকে একদম রেডি হয়ে বের হতে দেখি সাড়ে তিনটে বাজে, এরপর ধরাচুড়ো পরে মালপত্র নিয়ে সন্তোষকে ডেকে চাবি ধরিয়ে দিলাম। ও চা লাগবে না কি জিজ্ঞাসা করল, আমি সবিনয়ে প্রত্যাখান করে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম, তখন ভোর চারটে দশ-পনের হবে। চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, রাস্তায় দু-একটা সারমেয় ছাড়া আর কেউ নেই; আজ ওরা একদমই বিরক্ত করল না,  আমাকে দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেলাম। দেখি এক জাপানী ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। উনি জিজ্ঞাসা করলেন মানালী যাবার বাস কখন আসবে এবং আমরাও মানালী যাব না কী? ওনাকে জানালাম আমাদের বাসের বদলে ইনোভার ব্যবস্থা করেছে। উনি বিশ্বাসই করলেন না।


ভোরে মানালীর গাড়ী ধরা

ঠিক সাড়ে চারটে নাগাদ একটা ইনোভা হাজির হল। দেখি সেই এইচ.পি.টি.ডি.সি’র ডিলাক্স বাসের যাত্রী ও এইচ.পি.টি.ডি.সি., লেহর ইনচার্জ এবং একজন হিমাচলী ড্রাইভার বসে। একে একে সাত জন যাত্রী এসে পড়ল, উনি বুকিং-এর সিনিয়ারিটি অনুযায়ী সবাইকে বসতে অনুরোধ করলেন। জাপানী ভদ্রলোক কিছুতেই মানবে না, ওনাকে সবাই মিলে বোঝাতে রাজি হলেন; আসলে ওনার কিছু করার সুযোগ ছিলনা, ওনাকে ১৫ তারিখ সকালে দিল্লী থেকে ব্যাংককের ফ্লাইট ধরতে হলে তর্ক করলে চলবে না। এবার মাঝের সারিতে ডানদিকে জানালার ধারে বসার ব্যবস্থা হয়েছে। ততক্ষনে ড্রাইভার গাড়ির মাথায় সব মালপত্র রেখে, প্লাস্টিক দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। যদিও আমাদের যাত্রাশুরুর নির্দিষ্ট সময় ভোর পাঁচটা ছিল, কিন্তু সবাই আগেই চলে আসাতে আমরা চারটে চল্লিশেই রওনা দিলাম। ড্রাইভারকে অনুরোধ করলাম, যদি সম্ভব হয় আজ রাত দশটা-এগারোটা মধ্যে মানালী পৌঁছে দিতে পারলে ভাল হয়। জাপানী ভদ্রলোকের সুবিধে হবে, উনি বয়স্কও বটে। ড্রাইভার জানাল সেরকম হলে ওরই লাভ, ও এককথায় রাজি হয়ে গেল; যদিও ওর কাছে খবর আছে রোটাং পাসে একটা তেলের ট্যাংঙ্কার উল্টে রাস্তা বন্ধ কাল থেকে হয়ত আজ রাস্তা খুলে যেতেও পারে। দেখাযাক না, আগে কেলং পর্যন্ত যাইতো, পরেরটা পরে ভাবা যাবে। আমি টুক করে একটা অ্যাভোমিন খেয়ে নিলাম।

আমরা এগিয়ে চললাম; একে একে চোগলামসার, শ্যে, থিকসে, কারু পেরিয়ে উপসি চলে এলাম। পথে দুএকটা ট্রাক বা মিলিটারি গাড়ী ছাড়া কোনও টুরিষ্ট গাড়ীর সাথে দেখা সাক্ষাত হল না। সব দোকান বন্ধ, মাত্র একটা চায়ের দোকান খোলা; তাতে বিস্কুট আর কেক ছাড়া আর কিছু নেই। কেউ ব্রেকফাস্ট করবে না বা চা খাবে না, আমি এককাপ চা বানাতে বললাম। ততক্ষনে দেখি ড্রাইভার প্লাস্টিক খুলে মাল নামাচ্ছে। কি ব্যপার জিজ্ঞাসা করাতে জানাল, বিহারী ভদ্রলোক এখানে নেমে যাবেন। বিহারী বাবুকে জিজ্ঞাসা করাতে সে জানাল এত লম্বা পথ সে পিছনে বসে যেতে পারবে না, আমি অভয় দিলাম যে মাঝেমাঝে আমরা সিট পরিবর্তন করব, কিন্তু ও রাজি হল না সকালের বাসে ও লেহ ফিরে যাবে এবং কাল অন্য কোনও বন্দোবস্ত করবে মানালী যাবার। এতক্ষনে চা চলে এসেছে; সামনে ড্রাইভারকে দেখে আমি একটা ফাঁকা গ্লাস আনতে বললাম। একটা কে দুটো করে ঠিক সাড়ে ছটার সময় নতুন উদ্যমে তাংলাংলার দিকে রওনা হয়ে গেলাম।


তাংলাংলা পাসে বিপত্তি

উপসী ব্রীজ পার করার পর চেকপোষ্টে পাসপোর্ট চেকিং করিয়ে ড্রাইভার একদম রাস্তার ডানধারের খাদ ঘেঁষে গাড়ী  চালিয়ে উপরে উঠতে লাগল। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল তাই সবার মত আমিও একটু চোখ বুজিয়ে ঘুমিয়ে নিলাম। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তাংলাংলার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। চারদিকে প্রচুর বরফ, রাতে তুষারপাত হয়েছে। জায়গায় জায়গায় তাঁবু, রোড কনসট্রাকশন কোম্পানির লোকেরা মুখ ধুচ্ছে আর কাজে বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু এগোতেই দেখি একটা লরি রাস্তার একটা সঙ্কীর্ণ অংশে একটু বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে, কিছু লোক শাবল, বেলচা দিয়ে চাকার কাছে জমে যাওয়া শক্ত বরফ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফেলছে। পাশ দিয়ে একজন মাত্র মানুষ কোনও মতে যাবার জায়গা আছে। ড্রাইভার রহস্য উদঘাটনে গেল আর আমরা পাশে হিমবাহর মত বরফ জমে থাকা পাহাড়ের গায়ে আড়াল করে নিজেদের একটু হাল্কা করে নিলাম।

পাহাড়ের জমাট বাঁধা বরফের গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে জল পড়ে রাস্তা ভিজে আছে, একটু নোংরা হয়ে গিয়েছে নিচের জমা ঝুরো বরফ গলে। তাপমাত্রা নিশ্চিতভাবেই শূন্য ডিগ্রীর বেশ কিছুটা নীচেই হবে, একে সকাল সাড়ে সাতটার মত বাজে, তায় প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। একেবারে হাড়ে ঠাণ্ডা লাগছে, বেশিক্ষন বাইরে থাকতে পারলাম না। তাংলাংলা গিরিপথের উচ্চতম অংশ এখান থেকে কিলোমিটার দুয়েকের বেশি হবে না। কপাল ভাল ভৌগলিক অবস্থানের জন্য এই মুহুর্তে উল্টো দিক থেকে যানবাহন আসছে না, এলে পৃথিবীর এই উচ্চতম যানজটের থেকে মুক্তি পাওয়া বড়ই কষ্টকর হয়ে যাবে। অবশ্য অনেক দুরে দুটো ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে বটে কিন্তু মনে হয় ওটাই তাংলাংলা গিরিসঙ্কট।

ড্রাইভার এসে খবর দিল, একটা খালি ট্রাক ওখানে রাস্তার জমাট বাঁধা বরফে পিছনের চাকা পিছলে গিয়ে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে না যাচ্ছে এগোনো না যাচ্ছে পিছনো, উভয়সঙ্কট। অনেক ড্রাইভার সেই আটকে যাওয়া গাড়ীর চালককে বলেছে যে সে গাড়ীকে সোজা করে দেবে কিন্তু সে গাড়ীর চাবি দিতে নারাজ এবং নিজে চেষ্টা করে না যাবে পিছনে না যাবে সামনে। আরও জানাল যে, বেলা নটা নাগাদ বর্ডার রোডসের একটি বুলডোজার বা পে-লোডার এসে ওকে পিছন থেকে তুলে ঠিক জায়গায় টেনে সরিয়ে দেবে, তারপর রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমার কাছে ভারি লাগছে। এখানের উচ্চতা প্রায় সাড়ে সতের হাজার ফুট, একটু বেশি নড়াচড়া হলেই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাইরে কনকনে ঠান্ডা, তাই বাইরে বার হবার বিশেষ উপায়ও নেই। আমাদের সঙ্গীসাথীরা বাইরে বার হয়ে সিগারেট খেয়ে নিজেদের গরম রাখতে লাগল; আমি চকোলেট চিবিয়ে নিজেকে গরম রাখতে লাগলাম। সমস্যা হচ্ছে এত ঠান্ডায় থেকে থেকে বাথরুম পায়, তাই যাতে শরীরের তরলের ভারসাম্য কমে না যায় তাই ঠাণ্ডা জলও নিয়মিত খেয়ে যেতে হচ্ছে। এদিকে পিছনে বেশ লম্বা গাড়ীর লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে। একে এখানে ঘণ্টাখানেকের বেশি এখনও পর্যন্ত দেরি হয়ে গিয়েছে, বেশ বুঝতে পারলাম আজই মানালী পৌঁছে যাবার স্বপ্নের এখানেই ইতি ঘটে গেল। বিস্কুট, চকোলেট ও জল খেয়ে ক্ষুধা নিবারন করতে লাগলাম।

যাই হোক, বেলা নটা পনের নাগাদ বুলডোজার এসে পিছন থেকে ট্রাকের পিছন দিকটা একটু তুলে ধরে বাঁ দিকে করে দিতেই ট্রাকটি সাথে সাথে চলতে লাগল। ওর পিছনে বুলডোজার/পে-লোডার, তারপর আমরা এবং আরও পিছনে বাকি সব যানবাহন। একটু বাদে আমরা ওদের পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম, অবশ্য একটা খালি ছোট মালবাহী গাড়ী একে অপরের সাথে রেস করতে করতে আমাদের ওভারটেক করে এগিয়ে চলে গেল। এখানে দু লেনের রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তাই পাথর খোঁড়ার কাজ বেশ জোর কদমে চলছে। একজন মানুষকে পাথরের ছায়ায় শুয়ে থাকতে দেখলাম, মুখচোখ দেখে মনে হল বেঁচে নেই; মনটা বিঃস্বাদ হয়ে গেল। এভাবেই তাংলাংলা গিরিপথ পার করে হু হু করে নিচে নামতে লাগলাম। এবার মোরে সমভূমি পার হতে হবে। জানালার কাঁচ তোলা কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম সামান্য ফাঁকফোকর দিয়েই প্রচুর ধুলো ভিতরে ঢুকছে, তাই মুখে রুমাল বেঁধে নিলাম।

বেশ খানিকটা পথ চলে এসেছি, দেখি একটা টাটাসুমো দিগন্তবিস্তৃত সমতলভূমিতে সামনের চাকা পাংচার হয়ে বসে আছে। আমাদের ড্রাইভার একটু বেঁকে ওদের কাছে গেল। ওদের ড্রাইভার জিজ্জাসা করল স্টেপনি (অতিরিক্ত হাওয়া ভরা চাকা) আছে কি না, আমাদের ড্রাইভার না বলে একটু অপেক্ষা করতে বলল অন্য কোনও গাড়ীর থেকে নিশ্চয়ই সাহায্য পেয়ে যাবে। আবার এগিয়ে চললাম ভাঙ্গাচোরা পিচঢালা পথে লাফাতে লাফাতে, কখনো অবশ্য বড় গর্ত থাকলে আবার মাটিতে। এভাবেই এক বাইক আরোহীর সাথে দেখা, লেহ যাবে; বলল তাংলাংলা কোন দিকে, কিভাবে যাবে - বললাম পিচের রাস্তা অথবা যে কোনও গাড়ী চলা পথ ধরে দু পাশে জাসকার ও হিমালয় পর্বতশ্রেণীকে মাঝখানে রেখে এগিয়ে যেতে হবে, এখানে হারানোর কোনও ভয় নেই।

এভাবেই একসময় কখনও ঘুমাতে ঘুমাতে কখনও জাগতে জাগতে প্যাঙ্গএ এসে পড়লাম। এসে আগে উইনচিটারটা ভাল করে ঝেড়ে নিলাম, ধুলায় রংই বদলে গিয়েছে। হাতমুখ ভাল করে ধুয়ে আবার ম্যাগী খেয়ে নিলাম এর পর এককাপ কফি খেয়ে আবার গাড়ীতে উঠে ঘুম দিলাম। পৌঁনে বারোটা নাগাদ আবার গাড়ী চলতে লাগল; কখন কাংলাজাল এবং লাচুলুংলা পার করে চলে এসেছি জানতেই পারলাম না, দেখি নাকিলা পাস পার হচ্ছি। একটু বাদেই আসবে গাটা লুপের উৎরাই।


গাটা লুপে টায়ার পাংচার

সবে গাটা লুপের দ্বিতীয় হেয়ার পিন বেন্ড পার হয়ে রাস্তার মাঝামাঝি, দেখি ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে দিল। কি ব্যপার, না আমাদের বাঁ-দিকের চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার চটপট স্টেপনি দিয়ে পাংচার হওয়া চাকা বদল করে, আমার সাহায্যে উপরে তুলে দিল তবে ততক্ষনে আরও কুড়ি মিনিট ব্যয় হয়ে গিয়েছে। এরপর গাড়ী সারচু এসে পৌঁছাল। এখানেও একপ্রস্থ চেকিং সেরে ড্রাইভার পাংচার হওয়া চাকা রিপেয়ার করাতে লাগল। কারন, আবার যদি রাস্তায় কিছু হয় তবে ভগবানই ভরসা! সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ মিনিট নষ্ট হয়ে গেল এখানে, অবশ্য ততক্ষনে আমি এককাপ কফি পঁচিশ টাকা (এই যাত্রা পথে সব থেকে দামি কফি) দিয়ে খেলাম। একটা কিয়াং (পাহাড়ি গাধা বা খচ্চর) চরছিল আসেপাশে। মাঝে মাঝে এক-দুটো গাড়ী সাঁ করে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে এই জন মানব হীন প্রান্তরে; কেবল পাংচার মেকানিক, কিছু নিরাপত্তা রক্ষী ও আমরা, আর আমাদের এক পাশে উত্তুঙ্গু পাহাড় অন্য দিকে বেশ খানিকটা দুরে নদী খাত।


আকাশের দিকে তাকালাম ভর দুপুর বেলা কিন্তু সূর্যর সাক্ষাত নেই, মেঘের ঘনঘটা, প্রমাদ গুনলাম। কারন আমাদের বারালাচালা পার করতে হবে এবং এখানে মেঘ মানে সেটা বারালাচাতে অবধারিত বৃষ্টি। মেকানিক ভদ্রলোকটি-ও জানাল রোটাং বন্ধ আছে। আমাদের সাথের বিদেশী যুবকটি যে সব জায়গায় একটু বেশি থেমেছে সেখানে একটু বেশী হাঁটাচলা করেছে এবং সারা রাস্তা পিছনে বসে আসছে, তাই বোধহয় ওর মাথা ঘুরছিল এবং মাথা ব্যথা করছিল, অর্থাৎ ওর উচ্চতাজনিত অসুখের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। সামনের সীটে বসা মেয়েটি ওকে একটা অ্যাসপিরিন দিল আর আমি ওকে মাঝখানের সিট অফার করলাম। ও মৃদু হেসে সানন্দে সম্মতি জানাল আর আমি পিছনে বসলাম; কাল সারাদিন পিছনেই বসেছিলাম, অনেকটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।

ভরতপুর আসার আগেই আবার ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, আসার সময় এখানে ব্রেকফাষ্ট করেছিলাম কিন্তু এখন কত তাড়াতাড়ি বারালাচা পার করা যায় তাই নিয়ে চিন্তা। কিলিংসরাই আসতে আসতে বেশ জোরে বৃষ্টি নেমে গেল, বারালাচায় প্রত্যাশা মতই হাল্কা তুষারপাত হচ্ছিল; জীবনের প্রথম তুষারপাত দর্শন। পিছনের জানালা খোলার উপায় ছিলনা তাই হাত বাড়িয়ে উপর থেকে নেমে আসা পেঁজা তুলোর মত বরফ ছুঁতে পারলাম না। মোটামুটি বেশ ভালই অন্ধকার, পূর্ব ভারতে গরম কালের সন্ধ্যা বেলার মতই আকাশ, উত্তর ভারতে বেলা চারটের সময়। বারালাচা পার হয়ে সুরজ তাল দেখতে দেখতে আমরা নিচে নামতে লাগল, অন্ধকারে বিশেষ বাইরে দেখা যাচ্ছিল না তাই একটু চোখ বন্ধ করে আরাম করে নিচ্ছিলাম আর ততক্ষনে আমাদের গাড়ী জিংজিংবার, পাটসিও পার করে দারচা চলে এল। ভাগা নদী পার হবার আগেই গাড়ী একটু দাড়াল, একটু চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিতে। এখন বৃষ্টির তেজ কিছুটা অস্তমিত হলেও পিছু ছাড়েনি। যাই হোক, প্রায় সব্বাই এক কাপ চার ফরমায়েশ করলাম; এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রমহিলা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, চা নিয়ে এল। বৃষ্টি তার সাথে বেশ ঠান্ডা নিয়ে এসে ছিল তাই গরমাগরম চা বেশ জমে গেল। দারচার চেকপোষ্টে সামান্য সময় নষ্ট করে আমরা জিস্পা হয়ে কেলং বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালাম, সময় তখন বিকাল ছটা। এসময় আকাশে বেশ আলো থাকে কিন্তু আজ মেঘলা বলে একটু অন্ধকার।


কেলং ও হোটেল চন্দ্রভাগা

কেলংএও টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। বাইরে শেডের তলায় দাঁড়িয়ে মোবাইল বার করে চালু করলাম, বি.এস.এন.এল. ও এয়ারটেল দুটোই পুরোপুরি সক্রিয়। একজন এসে জিজ্ঞাসা করল হোটেল চাই নাকি, বললাম বুক করা আছে। লোকটি চলে গেল আর আমাদের ড্রাইভার সামনের সিটের আরোহীদের মাল-পত্র নামাতে লাগল, ওরা এখান থেকে কাল সচ পাসের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আমি ওদের জায়গায় সামনের সিট দখল করলাম। মালপত্র নামিয়ে ওনাদের বিদায় জানিয়ে আমরা হোটেল চন্দ্রভাগায় হাজির হলাম। মোট চারজন লোক, রাস্তা বন্ধ থাকায় মানালী থেকে নতুন কেউ আসবেনা তাই হোটেল ইনচার্জ দয়াপরবশ হয়ে আমাদের তাঁবুর বদলে ডর্মিটারিতে থাকতে বলল। সবাই যে যার লাগেজ নিয়ে ডর্মিটারিতে হাজির হলাম; একটা ঘরে সাতটা বিছানা (মোটামুটি পরিস্কারই), দুটো টেবিল, একটা দেওয়াল আলমারি এবং একটা কমন বাথরুম। সবাই একএকটা দখল করলাম, ড্রাইভার আমাদের সাথে এল কিন্তু জানাল ও গাড়ীতে ঘুমাবে। ও গাড়ীতেই ঘুমায়, স্লিপিং ব্যাগ আছে, কম্বল আছে কোনও অসুবিধা হবে না তারপর গাড়ী চুরির ভয়; অনেক অনুরোধেও ওকে দিয়ে ডর্মিটারির কোনও একটা খালি বিছানা দখল করানো গেল না, বড়ই অদ্ভুত লোক!

হাত পা ধুয়ে এসে মোবাইল চার্জে বসিয়ে গ্লাস দুয়েক জল খেয়ে ওদের দেওয়া কমপ্লিমেন্টারি চা খেয়ে নিলাম। এরপর সবাই একটু বারান্দায় বসে যে যার বাড়িতে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ড্রাইভারকে বললাম কাল ভোরে রওনা দিতে। সময় ঠিক হল ভোর পাঁচটা। কারন ট্রাকের সারি ও রোটাং-এ ট্যুরিষ্ট আসা শুরু হবার আগেই রোটাং পার হতে হবে; যদি রাস্তা খুলে যায় তবে সকাল সকাল মানালী পৌঁছে যাব। আটটা বাজার কিছু আগেই আমাদের স্যুপ দিয়ে দিল এবং আমি দ্রুত সেটা শেষ করে গরম গরম রুটি ও তরকারি সহযোগে রাত্রের আহার শেষ করে সাড়ে আটটার মধ্যেই ঘুমাতে গেলাম। এবার আর্ল্যাম ভোর(রাত) সাড়ে তিনটের।

কেলং থেকে মানালী রওনা

এই মঙ্গলবারও অন্যান্য দিনের মত আর্ল্যামের শব্দে ঘুম ভাঙল এবং আমি এক লিটারের একটি জলের বোতল শেষ করে, হোটেলের দেওয়া এক কাপ চা খেয়ে, একটু এদিক ওদিক করতে করতে শেষমেশ প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ সমস্ত সকালের অবশ্য কাজকর্ম সেরে রেডি হলাম। হোটেলের থেকে প্যাকেট ব্রেকফাষ্ট নিয়ে সব মালপত্র নিয়ে গাড়ীর কাছে হাজির হলাম। এবার মালপত্র গাড়ীর ছাদে চড়ল না বরং পিছনের সীটে চড়ল এবং আমি সামনের আসনে সওয়ার হলাম। প্রায় পাঁচটা দশ নাগাদ গাড়ী এগিয়ে চলতে শুরু করল। সকাল থেকেই বুঝতে পারছিলাম আজ আর আকাশে মেঘ নেই এবং বৃষ্টি হবার সম্ভাবনাও কম।

আমাদের গাড়ীর জ্বালানী কম ছিল, ড্রাইভারের কথায় হয়ত মানালী পৌঁছে যাবে কিন্তু লিটার পাঁচেক আরও পেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়; রোটাং-এর জ্যামে আটকালে কিন্তু মানালী অবধি পৌঁছান সম্ভব হবেনা। মাত্র আট কিলোমিটার দুরেই তান্ডিতে পেট্রোল পাম্প আছে কিন্তু ওখানে পৌঁছে দেখি সব বন্ধ। কাছেরই এক স্থানীয় বাসিন্দা জানাল সকাল সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ ওরা পাম্প চালু করে; এখন ভোর সাড়ে পাঁচটাও বাজেনি। চারদিক এত সুন্দর যে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না; সাথে যে ক্যামেরা আছে ভুলেই গিয়েছি। আসলে এতদিন কেবল প্রকৃতির রুক্ষ সৌন্দয্য উপভোগ করেছি এবং এই রাস্তায় আগে যখন গিয়েছি তখন ঘন অন্ধকারে পাহাড় এবং অল্প হলেও সবুজের সমারোহ দু চোখ ভরে দেখবার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বৃষ্টি প্রকৃতিকে আরও কিছুটা বেশী সবুজ করে তুলেছে। মাঝেমাঝে কিছু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় সাইকেল আরোহী সাইক্লিং করে তাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছে। এগোতে লাগলাম, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে গোন্ডা, শিশু হয়ে খোকসার পৌঁছে গেলাম। এখানে একপ্রস্থ পাসপোর্ট চেকিং ব্রেক, সকালে বোধহয় ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ব্যস্ত ছিলেন অন্য কোনও কাজে, তাই ছাড়া পেতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। আমাদের পিছনে একটা বাস কেলং থেকে এসে দাড়াল, কাজা যাবে। আমরা সবাই এখানে সুলভ শৌচাগারের সুবিধা নিলাম; আগে মানালী ও লেহতে দেখেছি কিন্তু খোকসারের মত ছোট জায়গায় এত চমৎকার ব্যবস্থা থাকবে আশা করিনি।

সাতটা কুড়ি নাগাদ এগোতে শুরু করলাম গ্রামফু হয়ে রোটাংপাসের উদ্দেশ্যে। এখানে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, কোথাও রাস্তা আছে কোথাও বা রাস্তার কোনও অস্তিত্বই নেই; কেবল কাদা মাটি। কিন্তু প্রকৃতি বড়ই মনোরম; সূর্যের তেজ নেই, সামান্য হলেও সবুজের ছোয়া আছে এবং রাস্তা যখন ঘুরে ঘুরে উপরে উঠেছে তখন রোটাং-এর চূড়ায় একরাশ মেঘ গায়ে লেগে আছে। আহাঃ, এক কথায় অনবদ্য! যত উপরে উঠছি রাস্তা তত খারাপ হচ্ছে; বর্ডার রোডসের, রোড কন্সট্রাকশন কোম্পানীর কর্মীরা শাবল, বেলচা, গাইতি নিয়ে প্লাস্টিকের গ্লাভস্ হাতে শীতের পোষাক গায়ে কাজে চলেছে।

এভাবেই একসময় রোটাং পাসের উচ্চতম অংশ পার করে নামতে শুরু করলাম। তাড়াতাড়ি ভালভাবে মানালী পৌঁছানই সবার মূল উদ্দেশ্য, বিশেষ করে আমাদের সঙ্গী জাপানী ভদ্রলোকের। এখানে ওখানে ঝাপ ফেলা তাঁবু, বরফে খেলা করবার প্রায় সব রকম সরঞ্জাম মজুদ রয়েছে, বেশ কিছু ঘোড়া বাঁধা আছে। ওদের পার করে আমরা পাহাড়ের ঢালের রাস্তা বেয়ে নামতে শুরু করলাম। প্রথম বাঁকেই দেখতে পেলাম সারিবদ্ধ ট্রাকের সারি। বেশ ভাল বুঝতে পারলাম কপালে অশেষ দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার যতটা পারল ট্রাকের লাইনের পাশ দিয়ে এগোতে লাগল কিন্তু সবাই থামতে বলছে কারন এভাবেই যানজট শুরু হয়। একসময় থামতেই হল কিন্তু রোটাং টপ থেকে সব মিলিয়ে দুই কিলোমিটার রাস্তাও এগোতে পারিনি।


রোটাং-এ ধ্বস এবং পাহাড়ের গা বেয়ে নামা

ড্রাইভার খোঁজ নিয়ে জানাল, আর যাওয়া যাবে না, আমরা যদি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে মারহী পার করে আর একটা বাঁক পেরতে পারি তবে ওখানে মানালি যাবার বাস বা অন্য কোনও গাড়ি পেতে পারি এবং সবাই তাই করছে ও আজ রাস্তা ঠিক হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। আমি এক ঘোড়ার মালিক-কে নিচে নামানোর খরচ জিজ্ঞাসা করলাম; ওরা সম্ভবতঃ মুসলমান, পোশাক ও চেহারা দেখে মনে হল। একজন এক হাজার টাকা চাইল, অপর জন মাত্র বারোশ চাইল। যাইহোক, ওদের ধন্যবাদ বলে গাড়ী থেকে নেমে একবার ঢালের দিকে তাকাতে বুক শুকিয়ে গেল। ড্রাইভার বলল পারলে নেমে যেতে, ও তেল জোগাড় করে ঠিক মানালী নেমে আসবে। আমি প্রথমে ভাবলাম, আমার কাছে একদিনের মত জল ও খাবার আছে, তো নামার প্রয়োজন কী? গাড়ীতেই অপেক্ষা করি। এদিকে জাপানী ভদ্রলোক এবং অন্য বিদেশী যুবকটি ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করে দিয়েছে। আমার যদিও লাগেজ হিসাবে একটা বড় ও একটা ছোট রুকস্যাক ছিল কিন্তু ওদের মিলিত ওজন ত্রিশ কেজির বেশী হবে এবং আমার ট্রেকিং-এর কোনও পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা না থাকায় ভয় পাচ্ছিলাম। অত্যন্ত কঠিনতম দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি মৃতদেহর স্তূপ (রোটাং কথার তিব্বতী অর্থ) বেয়ে আমাকে নামতে হবে। কতশত বিদেশী শত্রুর আক্রমণ রুখে দেওয়া এই পাহাড়েই বোধহয় আমার সলিল সমাধি হবে!

উপায়ান্তর না দেখে, আমি পিঠে ঢাউস রুকস্যাক নিয়ে ও হাতে অন্য ছোট রুকস্যাক নিয়ে হাঁটা দিলাম কিন্তু ঢাল দেখে প্রথমেই আমার পা কাঁপতে লাগল। ঢাল প্রায় চল্লিশ থেকে পয়ঁতাল্লিশ ডিগ্রী হবে এবং সময় তখন প্রায় সকাল আটটা, দেখি একটি মহিলা প্রায় ৩-বছরের ছেলে কে পিঠে কাপড় নিয়ে বেঁধে ঢাল বেয়ে নামতে লাগল। বোধহয় একটু পৌরুষে লাগল, আমিও কালবিলম্ব না করে ওনাকে অণুসরন করলাম। উনি স্থানীয় বাসিন্দা, আমি ওনার সাথে নামতে নামতে একটু পড়েই থামতে বাধ্য হলাম, কারন হাঁটু ও পায়ের ডিমে অসম্ভব ব্যথা করছে – আমার পাহাড় চড়ার কোনও অভিজ্ঞতা নেই যে; কিন্তু ততক্ষনে আমি নামার সাহস পেয়ে গিয়েছি ও নামা বেশ উপভোগ-ই করেছি। একটু নামতে না নামতেই হাঁটু ব্যথায় ঠকঠক করে কাপতে লাগল। ঘোড়া গুলিও খুব পাজি, হুড়মুড় করে নামা ও ওঠার সময় প্রায় গায়েই উঠে পড়ছে। ওদের পিঠে মানুষ নেই, ওরা উপর থেকে মটরশুটির বস্তা নামিয়ে আনছে, অবশ্য কয়েকজন টুরিস্ট তাদের মালপত্র উপরে তুলছে, কারন একবার উপরে উঠে পড়লে রোটাং-এর অন্য দিকে যাবার গাড়ীর কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

একটু অসাবধান হলেই অন্তত এক দুই হাজার ফুট নিচে, আর পড়লে বাঁচার সামান্য সম্ভাবনাও নেই; কোনও হুড়োহুড়ি নেই, তাড়া নেই তাই একটু নেমেই থেমে থেমে বিশ্রাম নিতে লাগলাম। তারপর রোটাং-এর বিশেষত্ব হল এর আলগা পাথর, ঝুরো মাটি এবং ধ্বস প্রবণতা, সেটা গত আট নয় দিনের বৃষ্টিতে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক রূপ নিয়েছে। পা যদি ঠিকঠাক জায়গায় না রাখা যায় তবে গড়িয়ে পড়া কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। কিছুদূর নেমে হাফাঁতে হাফাঁতে উপরের দিকে তাকালাম। দেখি রাস্তা জুড়ে ট্রাকেরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একটু দুরে বাঁ দিকে (উপরে তাকালে) একটা তেলের ট্যাঙ্কার ঝুলছে। একটা ছোট ক্রেন এসে তোলবার চেষ্টা করছে কিন্তু তুলে রাখবার মত কোন জায়গা নেই, না আছে মাটিতে জোর। ট্যাঙ্কারকে গড়িয়ে ফেলে, রাস্তা মেরামত করবার চেষ্টা করলেই সবথেকে ভাল এবং সহজ সমাধান। দেখে একটু ভয় লাগল অবশ্য, যদি আমার ঘাড়ে পড়ে; যদিও সে সম্ভাবনা একটুও নেই আমার নিকটবর্তী গন্তব্যর মাথার উপরে সে অবস্থান করছে না।

এখানে ওখানে ঘোড়ার ময়লা পড়ে, ও সবের থেকে লাগেজ বাচিয়ে মোট পাঁচ বার থেমে মারহী পার করে একটা বাঁকে নামলাম, সময় লাগল পাক্কা চল্লিশ মিনিট।  ততক্ষনে আমার জামা ও ইনার ঘামে ভিজে গিয়েছে। আমার আন্দাজ ছিলনা যে সকালের কনকনে ঠান্ডায় নামতে ঘামও হতে পারে, যাইহোক জামা পাল্টে মানালি যাবার সওয়ারী খুঁজতে লাগলাম। পিঠে ও পায়ে ভয়ংঙ্কর ব্যথা। সরকারী বাসে পা রাখার জায়গা নেই, পরেরটা কবে আসবে কে জানে? একটা টাটাসুমো-তে অনেক দরাদরি করে দুশো টাকার বিনিময়ে (বাসে কুড়ি টাকা লাগত) ড্রাইভার সমেত এগারো জনের একজন হয়ে পিছনের সীটে চড়ে বসলাম। আমি পিছনে মাথা হেলিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। একসময় চোখ মেলে দেখি মানালি পৌঁছে গিয়েছি। আমাদের মানালীর সুলভ শৌচালয়ের সামনে নামিয়ে দিয়ে টাটা সুমো আবার মারহীর রাস্তা ধরল।


অবশেষে মানালী 

এবার আমি ম্যাল সংলগ্ন বাস স্ট্যান্ডের উল্টো দিকের নিউ আশাপুরী ভোজনালয়ে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম দু-দিনের থাকার জন্য কোনও ভাল হোটেল সন্ধানে আছে নাকি? উনি এক জায়গায় ফোন করে একজনকে ডেকে আনলেন, বললেন ভাড়া আড়াইশ থেকে তিনশ টাকার মধ্যে হবে, একবার গিয়ে দেখে আসতে, যদি পছন্দ না হয় অন্য ব্যবস্থা করা যাবে এখন অফসিজন তাই হোটেল বা ঘরের অভাব হবে না। আমি মালপত্র সমেত ছেলেটিকে অনুসরণ করলাম। পাসের গলি দিয়ে এঁকেবেঁকে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই হাজির হলাম হোটেল হিল ভিউ-তে। উপরে তিনতলায় ঘর, অপরিসর সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম। ঘর সংলগ্ন একটা বারান্দা আছে, সে জায়গা দিয়ে দুরে পাহাড় একটু দেখা যাচ্ছে বইকি,  টেলিফোন এক্সচেঞ্জ রাস্তার প্রায় অপর প্রান্তে। ঘর সংলগ্ন গিজার সমেত বাথরুম আছে তবে হাওয়া বাতাস বের হবার জায়গা কম। ঘরটি পরিষ্কার, কেবল কানেকশন সহ টিভি আছে, দুটি কাঠের এবং একটি প্লাস্টিকের আছে চেয়ার আছে একটি কাঠের টেবিল সহ। মালপত্র রাখবার জন্য একটি কাঠের দেওয়াল আলমারি আছে। কাজেই সব বিবেচনা করলে যথেষ্টই সস্তা।

আমি নিচে নেমে কত লাগবে জিজ্ঞাসা করাতে জানলাম ট্যাক্স সহ দুশ-পচাত্তর টাকা লাগবে দিন পিছু এবং আজ বারোটার আগে চেক-ইন করলেও অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না। আমি রাজী হয়ে নাম, ধাম লিখে অগ্রিম কিছু দিতে গেলে ওনারা বললেন একেবারে যাবার সময় দিলেই হবে। উপরে এসে গরম জলে সাবান এবং শ্যাম্পু সহযোগে স্নান করলাম এবং আবার ভোজনালয়ে হাজির হয়ে গরম ভাত খেয়ে হাজির হলাম ম্যাল সংলগ্ন হিমাচল রোড ট্র্যান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বুকিং অফিসে, ওখানে পনের তারিখে সকাল নটার মানালীচন্ডীগড় এসি ভলভো বাসে টিকিট কেটে নিলাম, ভাড়া জন পাঁচশ পাঁচ টাকা। এবার হোটেলে ফিরে টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে জানতে পারলাম এবারের দু হাজার দশের ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ স্পেন জিতে নিয়েছে ইনিয়েস্তার দেওয়া একমাত্র গোলে নেদারল্যান্ডকে হারিয়ে।

বিকালে প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে হোটেল কতৃপক্ষের কাছে আমার কিছু পোশাক লন্ড্রিতে পাঠানোর জন্য সর্মপণ করে ম্যালে গিয়ে রাস্তা সংলগ্ন একটি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে পরের দিন মনিকরন বেড়ানোর জন্য ফোর্স ট্রাভেলার গাড়ীর (ড্রাইভার বাদে এগারো জন চড়তে পারে) সামনে ড্রাইভারের বাঁ দিকে সিট আড়াইশ টাকা দিয়ে বুক করে এলাম। ফেরার টিকিট পরশু রাত্রে, চন্ডীগড় থেকে কালকা মেলে; সুতরাং কালকের দিনটা যাতে হোটেলে বসে নষ্ট না হয় সেটা নিশ্চিত করলাম। ম্যালের নো ডিসকাউন্ট শপে গিয়ে বাড়ির জন্য অনেক কিছু কেনা কাটা করলাম এবং বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন পাঞ্জাবী ধাবা থেকে চিলি চিকেন এবং তন্দুরি রুটি কিনে হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে একটু টিভি দেখে সাড়ে নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।


মনিকরন

অ্যার্লাম যদিও সকাল সাতটায় দেওয়া ছিল আমার ঘুম ভাঙল সকাল ছটায়। এরপর সবাই রেডি হয়ে ঠিক আটটার সময় ভোজনালয়ে এসে পৌঁনে নটার মধ্যে খেয়ে একবার হোটেলে ফিরে ছোট পিঠে ব্যাগ ও ক্যামেরা নিয়ে ঠিক সাড়ে নটায় মনিকরন যাবার জন্য টিকিট হাতে নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হয়ে দেখি একটি সাদা রং-এর ফোর্স ট্রাভেলার গাড়ী অপেক্ষা করছে। ওতে চড়ে বসলাম এবং সবাইকে নিয়ে ঠিক নটা চল্লিশ নাগাদ গাড়ী কুলুর দিকে রওনা দিল।

আমাদের প্রথম গন্তব্য হল শীভালকো কুলু শাল ফ্যাক্টরি। এখানে কুড়ি মিনিটের বিরতি। এখানে আমরা দেখে নিলাম পশমের মেশিনে বোনা শালের সম্ভার এবং যন্ত্র। সবাই অনেক কিছু কিনছে কেবল তিন বিদেশিনী বাদে। আমি আমার স্ত্রীর জন্য একটি চাদর কিনে নিলাম।

এরপর আমরা আরও এগিয়ে বাঁ দিকের বিয়াস নদীর উপরের ব্রীজ পার হয়ে নদীর বাঁ দিকের রাস্তা ধরে একটা বিশাল ব্রীজ এবং টোল বুথ পার হয়ে বাঁ দিকে ঢুকে পড়লাম কাসোল হয়ে মনিকরনের দিকে। এখানে বাঁ দিকে রয়েছে পার্বতী নদী, এটিতে বিয়াসের তুলনায় জল ও বেশী এবং অনেক বেশি খরস্রোতা। আজ আকাশে বিন্দুমাত্র বৃষ্টির মেঘ নেই, সূর্য তার তেজ বিকিরণ করছেন একেবারে মধ্যগগনে বিরাজমান হয়ে তবে জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া গাড়ীর ভিতরে মনোরম আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে। পার্বতী নদী এবং পারে দেবদারু গাছ এক অসাধারন যুগলবন্দী তৈরি করেছে। আমরা এগিয়ে চললাম সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে, উল্টোদিক থেকে অবিরাম নামাবলী গায়ে বাইক আরোহী আসছে, কখনও বা ট্রাক। আজ বুধবার, যদি সোমবার হত তবে শ্রদ্ধালুদের ভিড় আরও বেশী হত, এভাবেই প্রায় একটা নাগাদ আমরা মনিকরণ এসে পৌঁছে গেলাম।

মনিকরণ হল পার্বতী উপত্যকায় অবস্থিত শিখদের এক পবিত্র তীর্থস্থান, এখানে একটি গুরুদোয়ারা আছে। এখানে উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। ড্রাইভার আমাদের এক-দেড় ঘণ্টা বাদে গাড়ীর সামনে দেখা করতে বলল। ওনাকে বললাম একটু গাইডের কাজ করতে, উনি আমাদের মিনিট পনের অপেক্ষা করতে বললেন কি একটা ব্যাগ এক জনকে দিয়ে আসতে হবে। রাস্তার এবং গুরুদোয়ারার মাঝে বয়ে গিয়েছে অত্যন্ত খরস্রোতা পার্বতী নদী। নদীর উপরের ব্রীজ থেকেই দেখা গেল এখানে হিন্দু দেবদেবীর মন্দিরও আছে।  গুরুদোয়ারার নিচে নদীর প্রায় গা বেয়ে পাথরের গর্ত থেকে ফুটন্ত টগবগে গরম জল পার্বতী নদীর হিম শীতল জলে পড়ছে। অনেকক্ষন প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ড্রাইভার বাবলু-জীর দেখা না পেয়ে আমরা ভিতরে ঢুকে পড়ে গুরুদোয়ারা দেখে ওখানে লঙ্গরে নিরামিষ কিন্তু অত্যন্ত উপদেয় খিচুড়ি এবং তরকারি খেয়ে নিলাম পেট ভরে। এরপর কিছু দান-দক্ষিনা দিয়ে ভিতরের দিকে ঢুকে শিব-পার্বতী মন্দির দেখে নিলাম। এখানে হাঁড়িতে চাল কাপড়ে বেঁধে উষ্ণ প্রস্রবণে রেখে দেওয়া হয়েছে, ভাত হয়ে যাবে বলে। এবার বাইরে বার হয়ে এলাম দেখি বাবলুজী দাড়িয়ে। উনি দেরি করবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বললাম দু-জায়গা দেখে নিয়েছি। উনি বললেন চলুন আপনাদের রাম মন্দির দেখিয়ে নিয়ে আসি। গুরুদোয়ারার ভিতর দিয়ে ঢুকে দেখি মনিকরণ বেশ ঘিঞ্জি জায়গা, দোকান-পাটে ছয়লাপ। পথে পড়ল প্রাচীন রঘুনাথ মন্দির এবং মাতা নৈনা-ভগবতী মন্দির। এরপর প্রাচীন রাম মন্দির, শিব মন্দির এবং হনুমান মন্দির দেখে ফিরে এলাম। আসার সময় একটা রেক্সিনের টুপী কিনে নিলাম, দাম মানালীর তুলনায় অনেক সস্তা এবং গুনমানে অন্তত সমমানের তো বটেই।

এরপর ফেরার পালা, একই রাস্তা হয়ে ফেরার সময় এবার দেখে নিলাম বৈষ্ণ মাতা মন্দির। এটি অবশ্য কুলুতে। এখানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সেটি কিছুক্ষন দেখে বৈষ্ণ মাতা দর্শন করে নেমে এলাম। এখানে ভগবানের ছবি তোলা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ কিন্তু লুকিয়ে একটি ছবি তুলে নিলাম। সন্ধ্যা ছটায় সময় মানালী পৌঁছানোর আগে শেষ দ্রষ্টব্য অ্যাঙ্গোরা রাবিট ফার্ম এসে প্রচুর খরগোষ দেখে নিলাম। বাবলু-জী জানাল ওনার ভাল নাম গম্ভীর সিং, ওনার বাবা প্রয়াত ফৌজি সিং; ওনাদের গাড়ী ভাড়া দেবার ব্যবসা (ফোনঃ ৯৮১৬০৯৩৩৪০/ ৯৮১৬২৯৩৩৪০)।

এবার হোটেলে ফিরে ঘর ভাড়া এবং লন্ড্রির খরচ মিটিয়ে ব্যাগ/ক্যামেরা রেখে বাইরে বার হয়ে এক কাপ করে চা খেয়ে নিলাম এবং নিউ আশাপুরী ভোজনালয়ে এসে খেয়ে হোটেলে ফিরে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম, কাল সকালে চন্ডীগড়ের বাস ধরতে হবে।


কালকা মেলে ধরার জন্য চণ্ডীগড়ের রওনা   

পরেরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ছটায় উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে মালপত্র নিয়ে হোটেল ছেড়ে নিউ আশাপুরী ভোজনালয়ে এসে নিরামিষ ভাতের থালি নিয়ে সাড়ে আটটায় বাসস্ট্যান্ডে এসে বাসে উঠে পড়লাম। সামনের দিকে একটা সিট ছেড়ে ডানদিকে জানালার ধারের সিট। ঠিক নটার সময় বাস ছেড়ে কুলু হয়ে মান্ডিতে দুপুরের খাবারের জন্য থেমে পাঞ্জাবের রোপারে সন্ধ্যা ছটা নাগাদ চা খেয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ চন্ডীগড়ের সেক্টর-৪৩ স্থিত আই.এস.বি.টি.-তে এসে উপস্থিত হলাম। আমি অটোর বদলে সাধারন বাসেই দশ টাকার বিনিময়ে ৩০বি বাসে চেপে চন্ডীগড় রেলস্টেশনে মিনিট পঁচিশের মধ্যে এসে পৌঁছালাম। বাসে একটু ভিড় ছিল কিন্তু আমার লাগেজ নিয়ে বসার জায়গা পেতে কোনও সমস্যা হয়নি। রাস্তায় এখানে ওখানে জল জমে আছে।

এবার ট্রেন কালকা মেল রাত একটা দশে। রেলওয়ে ক্যান্টিনে খেয়ে ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ট্রেন আসতেই আমি নির্দিষ্ট সিটের দখল নিয়ে শুয়ে পড়লাম এর পরের কথা বড়ই একঘেয়ে, বরং অন্য কোনও দিন অন্য কোনও বেড়ানোর কথা লিখব। আজ এই পর্যন্তই; আমার কথাটি ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো।



…:::ধন্যবাদ:::…

*** *** *** *** *** *** *** *** ***
লাদাখের ভিডিও



*** *** *** *** *** *** *** *** ***